চল্লিশটি হাদিস মুখস্ত করার ফযিলত
বিদায় হজ্বের ভাষণে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুরআন আর সুন্নাহকে আঁকড়ে থাকার উপর জোর দিয়েছেন। যতদিন মুসলিম জাতি কুরআন এবং সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরেছিল, ততদিন দিকে দিকে তাদের বিজয়ের পতাকা পতপত করে উড়েছিল।
যখনই তাদের মধ্যে এ দুটোর প্রতি অনিহা এসেছে, তখনই দিকে দিকে, দেশে দেশে পরাজয়ের গ্লানি তাদেরকে অক্টোপাসের মতো চারদিক থেকে ঝাপটে ধরেছে। পরিবার, সংসার, সমাজ ও রাষ্ট্রে দেখা দিয়েছে অভূতপূর্ব সমস্যা আর হতাশা। এক সমস্যা থেকে পরিত্রাণ পেতে না পেতেই তৈরি হচ্ছে নতুন সমস্যা। জীবন যেন কুব্জ হয়ে নুইয়ে পড়া বৃদ্ধের আকার ধারণ করেছে। এর থেকে পরিত্রাণের একমাত্র পথই হলো রাসূলের দেখানো পথ, কথা ও কাজের অনুসরণ। তা যত ছোট আর সামান্যই হোক, রাসূলের ছোট্ট একটি সুন্নাহও বড় বড় বিপদ থেকে আমাদের রক্ষা করতে পারে।
কুরআন শেখা এবং অন্যকে শেখানোর উপর জোর দিয়ে বেশ কিছু আয়াত রয়েছে। পাশাপাশি রয়েছে অসংখ্য হাদিস শরীফও। ঠিক তেমনিভাবে হাদিস শরীফ আয়ত্ব করা এবং তা অন্যের নিকটে পৌঁছে দেয়ার প্রতিও অত্যন্ত জোর দেয়া হয়েছে। আল্লাহ পাক বলেন, ”রাসূল তোমাদেরকে যা দেন তা গ্রহণ কর এবং যা নিষেধ করেন তা থেকে বিরত থাক এবং আল্লাহকে ভয় কর। নিশ্চয় আল্লাহ কঠোর শাস্তিদাতা।” [সুরা হাশরঃ ৭] অন্য আয়াতে এসেছে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজ থেকে মনগড়া কিছু বলেন না। কাজেই রাসূলের বাণী, কর্ম, সম্মতি এবং পাশাপাশি সাহাবা কেরামের কথা, কাজ এবং ঐক্যমত্ত উম্মতের জন্যে অনুকরণীয় এবং অনুসরণীয়। তাছাড়া রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সুন্নাহতে রয়েছে আল্লাহ প্রদত্ত জ্ঞানের এক বিশাল ভাণ্ডার। যা প্রতিটি মু’মিনের জন্যে কল্যাণকর।
হযরত যায়েদ বিন ছাবিত রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, “আল্লাহ পাক ঐ ব্যক্তির কল্যাণ করেন, যে ব্যক্তি আমাদের কাছ থেকে একটি হাদিস (কথা) শোনে এবং তা মনে রাখে, যাতে সে অন্যের নিকট তা পৌঁছে দিতে পারে। হয়তো সে তা এমন একজনের কাছে পৌঁছে দেয় যে তারচেয়ে এর মর্যাদা সম্পর্কে বেশি অবগত। সে এমন জ্ঞান পৌঁছে দিচ্ছে যার সম্পর্কে সে নিজেও হয়তো তত অবগত নয়।” [তিরমিজিঃ ২৬৫৬; আবু দাউদঃ ৩৬৬০; ইবনে মাজাহঃ ২৩০]
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর কথাগুলো পরবর্তী মানুষের কাছে পৌঁছে দেবার জন্য বিদায় হজ্বের ভাষণেও বেশ গুরুত্ব দিয়েছেন। ফলে যুগে যুগে মুহাদ্দিস, মুফাসসির, ইমাম এবং ইসলামী চিন্তাবিদগণ নিজেরা যেমন হাদিস সংগ্রহ করেছেন, অন্যেরা যাতে সেসব হাদিস জানতে ও শিখতে পারে সেজন্য অক্লান্ত পরিশ্রমও করে গেছেন। বিভিন্ন হাদিসের ভেতরে আমরা তাই এমন সব ঘটনার উপস্থিতি লক্ষ্য করি যেখানে সাহাবাগণ রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইন্তিকালের পর শত শত কিমি পথ পায়ে হেঁটে একেকটি হাদিস সংগ্রহ করেছেন। কেউ একটি হাদিস জানেন, তাঁর কাছে ছুটে যাবার জন্য এবং তা শ্রবণ করার জন্য অন্য সাহাবা কিংবা তাবেঈনগণ উন্মত্ত হয়ে থাকতেন।
হাদিস শাস্ত্রে এমন অনেক মুহাদ্দেসীনের নাম ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা রয়েছে যারা লক্ষ লক্ষ হাদিস সনদ বা বর্ণনাকারীর নাম ও পরিচয়সহ মুখস্ত জানতেন।
দৈনন্দিন জীবনের নানান ব্যস্ততা এবং জীবন-জটিলতার মাঝে হয়তো সেভাবে লক্ষ লক্ষ হাদিস মুখস্ত করা আমাদের পক্ষে সম্ভব হবে না, আর তাই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অন্তত চল্লিশটি হাদিস মুখস্ত রাখা এবং তা প্রচার করার ব্যাপারে সাহাবাগণকে উৎসাহিত করেছেন। কমপক্ষে চল্লিশটি হাদিস মুখস্ত রাখা এবং তা প্রচার করার জন্য রয়েছে অকল্পনীয় ফযিলত। হযরত ইবনে আব্বাস, আনাস এবং আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম কর্তৃক বর্ণিত। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ”যে ব্যক্তি দীনের খেদমতে আমার হাদিস থেকে চল্লিশটি হাদিস মুখস্ত রাখবে এবং তা অন্যের কাছে প্রচার করবে, হাশরের দিন আল্লাহ্ পাক তাকে ফকীহ এবং আলেমগণের কাতারে শামিল করবেন।” [মুসনাদে আবু ইয়ালা, জামি বয়ানুল ইলম ওয়া ফাদ্বলিহঃ ১:১৯৪, কানযুল উম্মালঃ ১০:১৩৬ (২৯১৮২)]
উল্লেখ্য, হকপন্থী আলেমগণ হলেন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতিনিধি। তাদের মর্যাথ সাধারণ মানুষের মর্যাদায় চেয়ে প্রায় ৭০টি ধাপ উপরে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদিস মুবারক থেকে ৪০টি হাদিস মুবারক মুখস্ত রাখা এবং অন্যের কাছে তা পৌঁছে দেবার পুরষ্কার হিসেবে আল্লাহ্ পাক হাশরের দিন এমন মর্যাদাপূর্ণ প্রতিদান দিবেন। সুবহানআল্লাহ!
ইবনে উমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, যে ব্যক্তি চল্লিশটি হাদিস শিখবে এবং আমার উম্মাহর নিকট পৌঁছে দেবে, কিয়ামতের দিন সে আমার শাফায়াত লাভ করবে কিংবা আমি তার জন্য সাক্ষী হবো। [জামি বয়ানুল ইলম ওয়া ফাদ্বলিহঃ ১:১৯৩]
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কারো জন্যে শাফায়াত করলে কিংবা সাক্ষী হলে তার আর চিন্তা কিসের!
চল্লিশটি হাদিস মনে রাখার গুরুত্বের উপর তের জন সাহাবা থেকে প্রায় শতাধিক হাদিস বর্ণিত হয়েছে, তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেনঃ আলী বিন আবি ত্বালিব, আবদুল্লাহ বিন মাসুদ, মুয়াজ বিন জাবাল, আবু দ্বারদ্বা, ইবনে উমর, ইবনে আব্বাস, আবু হুরায়রা এবং আবু সাঈদ খুদরী (রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুম আজমাঈন)।
এখানে গুরুত্ব বিবেচনা করে চল্লিশটি হাদিস সংকলন করা হয়েছে। আপনি চাইলে এই হাদিসগুলো মুখস্ত করতে পারেন, চাইলে অন্য হাদিসও মুখস্ত এবং প্রচার করতে পারেন। আল্লাহ্ পাক আমাদের সবাইকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যতোগুলো হাদিস সম্ভব মনে রাখা এবং তা অন্যের কাছে পৌঁছে দেবার জন্য কবুল করুন এবং তা আমাদের জন্য সহজ করে দিন। আমীন, ইয়া রাব্বাল আলামীন।
১ম হাদিসঃ প্রতিটি কাজ তার নিয়তের উপর নির্ভরশীল
عَنْ عُمَرَ بْنِ الْخَطَّابِ رضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ: سَمِعْتُ رَسُولَ اللَّهِ ﷺ يَقُولُ: “إنَّمَا الْأَعْمَالُ بِالنِّيَّاتِ، وَإِنَّمَا لِكُلِّ امْرِئٍ مَا نَوَى، فَمَنْ كَانَتْ هِجْرَتُهُ إلَى اللَّهِ وَرَسُولِهِ فَهِجْرَتُهُ إلَى اللَّهِ وَرَسُولِهِ، وَمَنْ كَانَتْ هِجْرَتُهُ لِدُنْيَا يُصِيبُهَا أَوْ امْرَأَةٍ يَنْكِحُهَا فَهِجْرَتُهُ إلَى مَا هَاجَرَ إلَيْهِ”. (متفق عليه)
উচ্চারণ: ‘আন উমারা বিন খাত্তাব ক্বালা সামি’তু রাসূলাল্লাহি ﷺ ইয়াক্বুল: ”ইন্নামাল আ’মালু বিননিয়্যাতি, ওয়া ইন্নামা লিকুল্লী আমরিম মা নাওয়া, ফামান কানা হিযরাতুহু ইলাল্লাহি ওয়া রাসুলিহি, ফা’হিযরাতুহু ইলাল্লাহি ওয়া রাসুলিহি। ওয়ামান কানাত হিজরাতুহু লিদদুনিয়া ইউছিবুহা আও ইমরাআতিন ইয়ানকিহুহা ফাহিজরাতুহু ইলা মা হাজারা ইলাইহি।
অনুবাদ: উমর বিন খাত্তাব (রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি নবী ﷺ কে বলতে শুনেছি – প্রতিটি কাজ নিয়তের উপর নির্ভরশীল আর মানুষ তার প্রতিটি কাজে নিয়ত অনুযায়ী ফল পাবে। সুতরাং যে ব্যক্তি আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের দিকে হিযরত করবে, তার হিযরত আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের দিকে হিযরত হিসেবেই গণ্য হবে। আর যে ব্যক্তি হিযরত করবে দুনিয়া অর্জন করা অথবা কোন মহিলাকে বিবাহ করার উদ্যেশ্যে, তার হিযরত সে হিসেবেই গণ্য হবে, যার উদ্যশ্যে সে হিযরত করেছে।
[সহীহ বুখারী, অনুচ্ছেদ: কিতাব, ১/৩০ হা: ৫৪; সহীহ মুসলিম, অনুচ্ছেদ: ইমারাহ ৩/১৫১৫ হা: ১৯০৭ সুনানে তিরমিজি, অনুচ্ছেদ: ফাযায়েল ও জিহাদ ৪/১৭৯ হা: ১৬৪৭]
ধারাবাহিক পোস্ট…..

Hi, I am Jabed Hossain from 10 Minute Madrasah. I am an online graver, working as freelancer. This site is only for spreading islam process.