ইসলামী প্রশ্ন ও প্রশ্নের শরয়ী উত্তর
প্রশ্নোত্তর: নামাযের কাতারে একে অপরের মধ্যে কতটুকু ফাঁকা রাখা
দরকার?
প্রশ্ন: নামাযের কাতারে একে অপরের মধ্যে কতটুকু ফাঁকা রাখা যায়? কোন কোন মুসল্লিকে দেখা যায় একেবারে গা ঘেঁষে ঘেঁষে দাঁড়ায়, আবার কেউ কেউ উভয় পা বিস্তর ফাঁক করে দাঁড়ায়। যা অস্বস্তির কারণ হয়। দয়া করে সঠিক পদ্ধতি জানালে কৃতজ্ঞ হবো।
উত্তর: কোন প্রকারের ওজর বা অসুবিধা না হলে নামাযে দাঁড়ানো অবস্থায় দু’পায়ের মাঝখানে চার (৪) আঙ্গুল পরিমাণ ফাঁক রাখা মুস্তাহাব এবং দু’পা-কে সোজা রেখে পায়ের আঙ্গুলগুলোকে কিবলা মুখী করে রাখা সুন্নাত। বিশ্ববিখ্যাত ফতোয়া গ্রন্থ ‘রদ্দুল মুহতার’-এ উল্লেখ রয়েছে-
وينغتى أن يكون بينهما مقدار اربع اصابع اليد لانّه اقرب الى الخشوع هكذا روى عن ابى نصر الدبوسئ أَنَّه كان يفعله- (ص-৩৭৪– –ج– ৩)
অর্থাৎ- নামাযে দাঁড়ানো অবস্থায় দুই পায়ের মাঝখানে হাতের চার (৪) আঙ্গুল পরিমাণ ফাঁক রাখা উচিত। কেননা, নামাযের মধ্যে খুশু বা একাগ্রতার জন্য এটি (দু’পায়ের মাঝখানে ৪ আঙ্গুল পরিমাণ ফাঁক রাখা) অতি নিকটবর্তী
হযরত আবু নসর দাবুসী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি থেকেও এমন বর্ণনা পাওয়া যায়- তিনি নিজেও এরকম আমল করতেন।
সুতরাং এ কথা প্রতীয়মান হল যে, নামাযে দাঁড়ানো অবস্থায় দু’পায়ের মাঝখানে চার (৪) আঙ্গুল পরিমাণ ফাঁক রাখা উত্তম ও সুন্দর পন্থা।
কেউ কেউ উভয় পায়ের মাঝখানে বিস্তর ফাঁক করে দাঁড়ায় আবার কেউ কেউ নামাযে দাঁড়ানোর সময় দু’পা যুক্ত করে দাঁড়ায় দেখতে কেমন লাগে। মূলত: এসব নামাযের খুশু-খুজু ও আদবের পরিপন্থি।
[রাদ্দুল মুহতার: ৩য় খন্ড, পৃষ্ঠা ৩৮৪, কৃত- আল্লামা আলাউদ্দীন খাচকপি হানাফী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি]
প্রশ্নোত্তর: নারী-পুরুষ এক সাথে জামাআত আদায় করা যাবে কিনা?
প্রশ্ন: কিছু দিন পূর্বে পরপর ২টি মসজিদে দেখতে পেয়েছি জামাতের পর বারান্দায় পুরুষের কাতারের সমানে ও পেছনে ২/১ মহিলা নামায আদায় করছে। যা দেখতে মসজিদের পরিবেশের আদবের বিপরীত মনে হলো। প্রশ্ন হলো, এভাবে নামায আদায় করা মহিলাদের জন্য শরীয়তে আছে কিনা? জানালে উপকৃত হবো।
উত্তর: মুসলিম মহিলাদের জন্য পর্দা সহকারে ঘরের ভিতরে নামায আদায় বেশি প্রিয় অত্যন্ত ফজিলতময় এবং তাদের ইজ্জত-আবরু রক্ষার জন্য বড়ই উপকারী। তবে হজ্জ এবং উমরার ক্ষেত্রে আলাদা/ভিন্ন কথা। এ মহিলা বিশিষ্ট সাহাবী হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে মাসউদ রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু-এর নিকট মসজিদে হাযির হয়ে নামাযে জুমা আদায় প্রসঙ্গে প্রশ্ন করলে তিনি তদুত্তরে বলেন
-ما مصلّى لامرأةِ مِنْ خير بَيْتِهَا-
অর্থাৎ- মহিলাদের জন্য সর্বোত্তম নামায হলো যা ঘরে তার খাস কামরায় আদায় করা হয়। বর্তমান ফিতনার জমানায় নাজুক অবস্থায় মা-বোনদের জন্য মসজিদে গমন করে পুরুষদের সাথে জামআত আদায় করা নিষেধ। যেহেতু ফিতনা-ফ্যাসাদ হতে বেঁচে থাকা নেহায়ত অপরিহার্য বিষয়।
এ প্রসঙ্গে ফতোয়ায়ে সিরাজিয়ায় উল্লেখ আছে-اما فى زماننا فلا تحضر الا ناث المساجد– অর্থাৎ- অবশ্যই বর্তমান আমাদের সময় মহিলারা মসজিদে হাযির বা উপস্থিত হবে না
। ফতোয়ায়ে দুররুল মুখতারে আল্লামা আলাউদ্দীন খাচকপি হানাফী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি বর্ণনা করেন- يكره حضورهن الجماعة ولو لجمعة وعيد على المذهب المفتى به لفساد الزمان-
অর্থাৎ- মহিলাদের জন্য পুরুষদের সাথে পঞ্জেগানা নামাযের জামাত, জুমা ও ঈদের জামাতে হাযির হওয়া ফিতনা-ফ্যাসাদের কারণে মাকরূহে তাহরিমা।
এটা হানাফী মাযহাবের চূড়ান্ত ফতোয়া বা ফয়সালা।
কিতাবুল হেদায়ার প্রসিদ্ধ ব্যাখ্যা গ্রন্থ ফাতহুল ক্বদিরে ইমাম ইবনুল হুম্মাম হানাফী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি বলেন-
بل عمم المتاحرون المنع للعجائز والشّواب فى الصلوات كلها لغلبة الفساد فى سائر الاوقات-
অর্থাৎ- পরবর্তী হানাফী ফক্বিহগণ যুবতী ও বয়স্ক সকল মহিলাদের জন্য ফ্যাসাদের আশংকা বেড়ে যাওয়ার কারণে সর্বাবস্থায় প্রত্যেক নামাযের জামাতে বের হওয়াকে নিষেধ করেছেন।
এ প্রসঙ্গে মাসিক তরজুমান জিলহজ্ব- ১৪৩৭ হিজরী, সেপ্টেম্বর-২০১৬ ইংরেজী সংখ্যা ৬৩ পৃষ্ঠায় বিস্তারিত নির্ভরযোগ্য প্রমাণ ও দলিল সহ বর্ণনা করা হয়েছে। তা সংগ্রহ করে জেনে নেওয়ার অনুরোধ রইল।
প্রশ্নোত্তর: নবী করীমের চাঁদকে দ্বিখণ্ড করা মু’জিজাটি ক্বোরআন ও হাদীসে আছে কিনা?
প্রশ্ন: নবী করীম (দ.) চাঁদকে দ্বিখণ্ড করেছেন সে মু’জিজাটি ক্বোরআন ও হাদীসের বর্ণনায় আছে কী? থাকলে ক্বোরআন ও হাদীস দ্বারা বিস্তারিত জানালে ধন্য হব।
উত্তর: প্রিয়নবী হুযূর পুরনূর সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম আরব জাতিকে ইসলামের দাওয়াত দিতে গিয়ে তাদের চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে মহান আল্লাহ্ তা‘আলার হুকুমে অসংখ্য মু’জিজা প্রকাশ ও সংঘটিত হয়েছে। তম্মধ্যে চন্দ্র দ্বিখণ্ডিত হওয়া/বিদীর্ণ হওয়া।
হাদীস ও তাফসিরবিশারদ ঐতিহাসিকগণের বর্ণনানুসারে প্রিয়নবী নুরে মুজাস্সাম রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক প্রদর্শিত ও অতি প্রসিদ্ধ নির্ভরযোগ্য মু’জিজা বা অলৌকিক ঘটনা। হিজরতের কয়েক বছর পূর্বে মক্কায় থাকাকালীন নিজ বংশ কুরাইশ ও মক্কার কাফির-মুশরিকদের একদল নেতা একদা আল্লাহর রাসূলের দরবারে চন্দ্র দ্বিখণ্ডিত করার কথা বলল।
তাদের মধ্যে আবু জাহেল, ওয়ালিদ বিন মুগিরাহ্, আস ইবনে ওয়ায়েল, আস ইবনে হিশাম, আসওয়াদ ইবনে আবদে ইয়াগুস, আসওয়াদ ইবনে মুত্তালিব, যামআহ ইবনুল আসওয়াদ ও নযর ইবনে হারেস প্রমুখ কাফের নেতারা ছিলেন। ঐ দিন রাতের আকাশে পূর্ণ চন্দ্র দেখা গিয়েছিলো, সে মুহূর্তে তারা বললো- আপনার নবুওয়াতের দাবী যদি সত্য হয়ে থাকে তাহলে এই চাঁদকে দ্বিখণ্ডিত করে দেখান।
প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করলেন- দ্বিখণ্ডিত হলে কি তোমরা ঈমান আনবে? তার বললো হ্যাঁ! এ প্রস্তাবের প্রেক্ষিতে প্রিয়নবী রাসূলে মাকবুল সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম মহান আল্লাহর প্রদত্ত ক্ষমতাবলে আপন হাত মোবারকের আঙ্গুল দিয়ে ইশারা করলে তাৎক্ষণিক চাঁদটি স্পষ্ট দ্বিখন্ডিত হয়ে যায়। দু’খণ্ডের মাঝখানে হেরা পর্বত দৃশ্যমান হলো।
চাঁদের একখণ্ড জাবালে আবী কুবাইস বরাবর, অপরটি কাইকাআন বরাবর দৃশ্যমান হলো। ইমাম ইবনে কাসীরসহ সংখ্যাগরিষ্ঠ ইসলামী ইতিহাস বেত্তাগণ এ ঘটনাকে নির্ভুল বলে মত ব্যক্ত করেছেন
। এ মু’জিজাকে ইঙ্গিত করে মহান আল্লাহ্ তা‘আলা ‘সূরা ক্বামার’ অবতীর্ণ করেন। যার প্রথম দুই আয়াত উক্ত ঘটনাকে নির্দেশ করে। মহান আল্লাহ্ ইরশাদ করেন-
اِقْتَرَبَتِ السَّاعَةُ وَانْشَقَّ القَمَرُ واِنْ يَرَوْا ايَةً يُّعرِضُوْا ويَقولوا سحر مُسْتَمِرّ- (سورة القمر- ১-২)
অর্থাৎ- কিয়ামত অতি আসন্ন, চন্দ্র দ্বিখণ্ডিত হয়েছে এবং যদি তারা (কাফির-মুশরিকরা) কোন নিদর্শন দেখে তবে মুখ ফিরিয়ে নেয় আর বলে এটাতো চিরায়ত জাদু।
[সূরা আল্ ক্বামার: আয়াত-১-২, পারা-২৭] এ প্রসঙ্গে হাদীসে পাকেও সুস্পষ্ট বর্ণনা পাওয়া যায়। যেমন সহীহ বুখারী ও মুসলিম শরীফে উল্লেখ রয়েছে-
عَن عبد الله ابن مسعودٍ قال انشق القمر على عهدٍ رسول الله صلى الله عليه وسلم شقّتين فقال رسول الله صلى الله عليه وسلم اشهدوا- (رواه البخارى ومسلم)
অর্থাৎ- প্রখ্যাত সাহাবী হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে মাসঊদ রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন- নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর সময়ে চাঁদ বিদীর্ণ হয়ে দ্বিখন্ডিত হয়েছিলো,
তখন রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম বললেন- ‘‘তোমরা সাক্ষী থেকো।’’
[সহীহ বুখারী শরীফ: হাদীস নং ৩৩৭৫ ও মুসলিম শরীফ: ] অপর হাদীসে বর্ণিত রয়েছে-
عن أنس ابن مالك قال أنّ اهل مكّةَ سالوا رسول الله صلى الله عليه وسلم أَنْ يُريَهُمْ ايةً فأراهُمْ القَمَرَ شِقَّيْنِ حَتّى راوا حِراءً بينهُمَا- (رواه البخارى)
অর্থাৎ জলীলুল কদর সাহাবী হযরত আনাস ইবনে মালিক রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, মক্কাবাসী (কাফিররা) রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট মু’জিজা /নিদর্শন দেখানোর দাবী জানালে- তিনি চাঁদকে দ্বিখন্ডিত করে দেখালেন,
এমনকি তখন চন্দ্র দুখন্ডের মাঝখানে তারা হেরা পর্বত দেখেছিল।
[সহীব বুখার শরীফ: পৃষ্ঠা ৩৮] কাফির ও মুশরিকরা মু’জিজার এই দৃশ্য দেখে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেল। তবুও তারা ঈমান আনেনি।
চন্দ্র দ্বিখণ্ডিত হওয়ার ঘটনা/মু’জিজা আ’লা হযরত ইমামে আহলে সুন্নাত শাহ্ আহমদ রেযা খান ফাযেলে বেরলভী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি কবিতা/না’তের মাধ্যমে তুলে ধরেছেন-
سورج الئے پاؤ پلٹے چاند اشارے سے هوچاك
اندهے نجدى ديكه لے قدرت رسول الله كى-
অর্থাৎ- তাঁর (প্রিয়নবীর) ইশারায় অস্তমিত সূর্য উদিত হলো। চন্দ্র দ্বিখন্ডিত হলো, অন্ধ নজদীরা আল্লাহর মাহবূব সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর মহান শক্তি (মুজিজা) দেখে নাও।
[সহীহ বুখারী শরীফ ও মুসলিম শরীফ, হাদ্বায়েকে বখশিশ: কৃত আ’লা হযরত শাহ্ আহমদ রেজা (রাহ.), শাহে হাবীবুর রহমান: কৃত- মুফতি আহমদ ইয়ার নঈমী (রাহ.)]
নতুন নতুন ইসলামিক কন্টেন্ট পড়তে আমাদের ওয়েব সাইট নিয়মিত ভিজিট করুন।