অপবিত্র হওয়ার কারণসমূহ, বহিরাগত অপবিত্র দূরীকরণের নিয়ম, মাসায়েল
অপবিত্র হওয়ার কারণসমূহ
মানুষ নাপাক হয় দু’ভাবে ৷ আভ্যন্তরীণভাবে এবং বাহিক্যভাবে ৷ বাহিক্যভাবে নাপাক হওয়ার অবস্থা আবার দু'টি ৷
যেমন- (ক) দেহাভ্যন্তরগত নাপাক ও (খ) বহিরাগত নাপাক ৷
(ক) দেহাভ্যন্তরগত নাপাকঃ
স্বামী-স্ত্রীর গুপ্ত অঙ্গ মিলিত হওয়া, যে কােনভাবে বীর্যপাত হওয়া, স্ত্রীলােকের হায়েয-নেফাস হওয়া ৷ উল্লেখিত অবস্থাগুলােতে মানুষ অপবিত্র হয় ৷ এসকল অবস্থায় পবিত্রতা হাসিলের জন্য গোসল করা আবশ্যক ৷ এছাড়া মানুষের মল মূত্র দ্বার হতে মল-মূত্র, বা অন্য কিছু বের হওয়া কিংবা শরীরের কোন জখমাদি হতে রক্ত, পুঁজ ইত্যাদি বের হয়ে জখমের মুখ হতে গড়িয়ে যাওয়ায় মানুষ লঘু নাপাক হয়, অর্থাৎ এসব অবস্থায় গোসলের প্রয়োজন হয় না কেবলমাত্র ওযু করলেই পবিত্রতা হাসিল হয় ৷
(খ) বহিরাগত নাপাকঃ
মানুষের মল-মূত্র অঙ্গে লাগা ৷ হারাম জন্তু অর্থাৎ যেসব জন্তুর মাংস হালাল সেগুলো ৷ যথা- গরু, ছাগল, ভেড়া, মেষ, দুম্বা ইত্যাদির মল-মূত্র, এছাড়া রক্ত, শরাব, শুকরের মাংস শুকরের পশম, শুকরের হাড় প্রভৃতি নাপাক বস্তুগুলাে শরীরে লাগলে শরীর নাপাক হয় ৷ এ অবস্থায় শরীরের নাপাক স্থানটুকু উত্তমভাবে ধুয়ে ফেললেই শরীর পবিত্র হয় ৷ এমতাবস্থায় গোসলের প্রয়োজন হয় না ৷ উল্লেখিত নাপাক বস্তু কাপড় চােপড়ে লাগলে তাও নাপাক হয়ে যায় । তখন তা ভালভাবে ধুয়ে পাক পবিত্র করতে হয়৷
নাজাসাতে গলীজা ও খফীফা
নাজাসাত সাধারণভাবে দু' প্রকার ৷
যথাঃ (ক) নাজাসাতে গলীজা ও (খ) নাজাসাতে খফীফা ৷ যেসকল নাপাক বস্তু শরীর বা কাপড় চােপড়ে এক দিরহাম কিংবা তদাপেক্ষা কম (হাতের তালু সোজা করে তাতে পানি ঢাললে যে স্থান ঢুকুতে পানি স্থির হয়ে থাকে, তাকে এক দিরহাম বলে) পরিমাণ লাগলে তা নিয়ে নামায পড়লে মাকরূহের সাথে নামায আদায় হবে, তাকে নাজাসাতে গলীজা তথা গুরু অপবিত্র বলে ৷ এ প্রকার নাজাসাত এক দিরহামের বেশি লাগলে তা নিয়ে নামায হবে না ৷ মল-মূত্র, রক্ত, পুজ, শুকরের মাংস, পশম, হাড় মানুষ কিংবা জ্বীব-জন্তুর শুক্র ইত্যাদি এ জাতীয় নাজেসাত ।
আর যেসকল নাপাক বস্তু শরীরে বা কাপড় চোপড়ে এক দিরহামের বেশি পরিমাণ লাগলেও তা নিয়ে নামায পড়লে মাকরূহের সাথে আদায় হবে; এ জাতীয় নাপাক বস্তুকে নাজাসাতে খফীফা তথা লঘু নাপাকী বলে ।
এ প্রকার নাজাসাত শরীরের কোন অঙ্গ প্রত্যঙ্গ বা কাপড়-চোপড়ের কোন এক অংশে এক চতূর্থাংশের কম পরিমিত স্থানে লাগলে তা নিয়েও মাকরূহের সাথে নামায হবে কিন্তু এক চতূর্থাংশ বা তার চেয়ে বেশি পরিমাণ স্থানে লাগলে তা নিয়ে নামায জ্বায়েয হবে না৷
বহিরাগত অপবিত্র দূরীকরণের নিয়ম
১। নাজাসাতে গলীজা শরীরে লাগলে পানি দিয়ে ঐ স্থান ভালভাবে ঘষে ধোবে। তার দাগ ও গন্ধ দূর না হওয়া পর্যন্ত ধুতে থাকবে ৷ অবশ্য কেউ কেউ বলেন উত্তমরূপে তিমবার ধোবার পরও যদি দাগ ও গন্ধ দূর না হয়, তবে তাতেই পাক হয়ে যাবে আর ধুতে হবে না।
২। নাজাসাতে গলীজা কাপড় চােপড়ে লাগলে তাও উপরোক্ত নিয়মে পবিত্র করতে হবে।
৩। অঙ্গ প্রত্যঙ্গে তরল নাজাসাত লাগলে তাও তিনবার ভালভাবে ঘসে ধুয়ে পবিত্র করতে হবে । আর তরল নাজাসাত কাপড় চােপড়ে লাগলে ভালভাবে রগড়িয়ে একবার ধোলে পবিত্র হবে ।
৪। কোন কাষ্ঠখণ্ডে কিংবা যমীনে নাজাসাত লাগলে তা না ধুয়ে যদি নাজাসাত লাগা কাষ্ঠাংশটুকু কেটে ফেলা হয় এবং নাজাসাত লাগা যমীনের নিম্ন হতে খুড়ে মৃত্তিকা উঠিয়ে ফেলা হয়, তবে ঐ কাষ্ঠখণ্ড এবং যমীন পবিত্র হয়ে যাবে ৷
৫। দা, কূড়াল, খোনতা, কোদাল, অলঙ্কারাদিতে নাজাসাত লাগলে উত্তমরূপে ঘষে মেঝে পরিষ্কার করিলেই পবিত্র হয়ে যায়, তবে নকশাদার তৈজসপত্র ও অলঙ্কারাদি হলে তার মধ্যে নাজাসাত লেগে থাকে বলে ঐ প্রকার দ্রব্যগুলাে উত্তমরূপে ধুয়ে পবিত্র করতে হয় ।
৬। হোগলা, চাটাই, পাটি, ইত্যাদিতে নাজাসাত লাগলে তা এভাবে ধুয়ে টানিয়ে রাখতে হবে । পানি ঝরে গেলে আবার ধুয়ে টানিয়ে রাখতে হবে । এভাবে তিনবার করতে হবে । এ বস্তুগুলাে নিংড়ানা সম্ভব নয়, সেজন্যই এরূপ করতে হবে ।
৭। ধাতব নির্মিত তৈজসপত্র এবং অলঙ্কারাদিতে তরল নাজাসাত লাগলে তাও ঐ নিয়মে ধুয়ে পবিত্র করবে । ধাতব দ্রব্যসমূহ আগুনে পােড়া দিলেও তার নাপাকী দূর হয়ে যায়।
জুমার নামাজের নিয়ত আরবি এবং বাংলা অর্থসহ
পবিত্র অপবিত্রের মাসায়েল
১। মশা, মাছি বা ছাড়পোকার রক্ত পবিত্র, সুতরাং তা শরীরে বা কাপড়ে লাগলে তা নিয়ে নামায আদায় করলে জায়েয হবে ।
২। অপবিত্র বস্তু মেশানাে তৈল কোন অঙ্গে মাখলে অঙ্গ নাপাক হয় ৷ ঐ অঙ্গ তিনবার রগড়িয়ে ধুয়ে পবিত্র করতে হয় ।
৩। অপবিত্র বস্তু মিশানো মেহেদী পাতার রং হাতে মাখলে তা ভালভাবে তিনবার ধুলেই পবিত্র হবে । এজন্য হাতের রং উঠিয়ে ফেলতে হবে না ।
8। কাফেরদের বস্ত্র পবিত্র অপবিত্র ইহা সন্দেহের কথা, এরূপ কাপড় পড়ে নামায পড়লে মাকরূহ হবে ।
৫। কুকুরের পশম বা দেহ নাজাসাত নয়, তবে তার মুখের লালা পবিত্র নয়।
৬. ভেজা কাপড় পড়া অবস্থায় বাহ্য মাকাম হতে হাওয়া বের হলে ঐ কাপড় অপবিত্র হয় না ।
৭। নাপাক বিছানায় শয়ন করলে শরীর বা পরিহিত বস্ত্র অপবিত্র হবে না । অবশ্য ঘর্ম নির্গত হয়ে নাজাসাতের সঙ্গে মিলে ঐ ঘর্ম দেহে বা বস্ত্রে লাগলে তা অপবিত্র হয়ে যায়।
৮। নাপাক পানিতে ভেজানাে কাপড়ের ওপর শুকনো পবিত্র কাপড় রাখলে তা অপবিত্র হয় না, তবে ঐ কাপড় হতে যদি তার নাজাসাত বা গন্ধ শুকনো কাপড়ে লেগে যায় অথবা ভেজা অপবিত্র কাপড়ের পানিতে যদি শুকনো কাপড়ও একবারে ভিজে যায় তবে তা অপবিত্র হবে ।
৯। জুতো কিংবা চামড়ার মোজায় রক্ত, বীর্য অথবা পাতলা গোবর লেগে শুকিয়ে গেলে যদি তা ঘামে কিংবা অন্য কিছুতে ঘসে উঠিয়ে ফেলা সম্ভব হয়, তবে তাতেই পবিত্র হয়ে যায়; পানি দ্বারা ধোয়ার প্ৰয়েজেন হয় না ।
১০। অবশ্য ঘন নাজাসাত জুতোয় বা মোজায় লাগলে পানি দ্বারা ধুয়ে পবিত্র করতে হয়।
১১। বেশি ঘন নাজাসাত জুতোয় লাগলে তা ঘসে উঠিয়ে ফেলতে পারলেই পবিত্র হয়ে যায়।
১২। কোন বৃহদাকার পবিত্র বিছানার চাদরের এক কোণে সামান্য জায়গায় নাজাসাত লাগলে সম্পূর্ণ ফরাশ বা বিছানা অপবিত্র হয় না । অর্থাৎ নাজাসাত লাগা কােণা বাদ দিয়ে তার অন্য কােণায় নামায আদায় করলে নামায আদায় হবে।
১৩। প্রস্রাব লাগানো কাপড়ের সাথে শুকনো কাপড় মিশিয়ে রাখলে তা অপবিত্র হয় না । অবশ্য প্রস্রাব বা তার গন্ধ লেগে গেলে অপবিত্র হয়ে যায় ।
১৪। জুতো কিংবা মোজােয় তরল নাজাসাত লাগলে তা ধুয়ে পবিত্র করতে হয় ।
১৫। নাজাসাত মিশ্রিত সুরমা বা কাজল চোখে দিলে তা না ধুয়ে নামায আদায় করা যায়, তবে চোখের পানিতে তা ভিজে গড়িয়ে গেলে না ধুয়ে নামায আদায় করা জায়েয নয়।
১৬। নাজাসাত মিশ্রিত রং কাপড়ে লাগলে ঐ কাপড় ধুয়ে নিংড়ে যতক্ষণ পর্যন্ত রঙিন পানি পড়তে থাকবে ততক্ষণ ঐ কাপড় পবিত্র হবে না । পানি রং শূন্য হলে কাপড় পবিত্র হয়েছে বুঝতে হবে ।
১৭। নাপাক মাটির ওপর পাক বালু বা মাটি বিছিয়ে তার ওপর নামায আদায় করলে বৈধ হবে।
১৮। শিশু সন্তান মার দুধ পান করে সাথে সাথে ঐ দুধ মার শরীরে বমি করে ফেলে যদি ঐ বমি তিনবার চেটে উঠিয়ে নেয় তবে ঐ স্ত্রীলোকের শরীর অপবিত্র হয়ে যাবে ।
১৯। গােবর অপবিত্র বটে; কিস্তু শুকনো গােবর জ্বালানাে ধোয়া কাপড়ে লাগলে সে কাপড় অপবিত্র হয় না ।
২০। চুন-সুরকী ছাড়া ইটের ওপর নাজাসাত লাগলে ঐ ইট ধুয়ে পবিত্র করতে হয় । ঐরূপ নাজাসাত শুকিয়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলেও না ধোয়া পর্যন্ত পবিত্র হবে না ।
২১। চুন-সুরকী দ্বারা প্রলেপ যুক্ত ইটে নাজাসাত লেগে তা শুকিয়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলে তার ওপর নামায আদায় করা যায়; কিন্তু ঐরূপ ইট দ্বারা তায়াম্মুম বৈধ নয় ।
২২। ঠিক ঐরূপ মাটিতে নাজাসাত নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলে সে মাটিতে দাঁড়িয়ে নামায আদায় করা যায় কিন্তু ঐ মাটিতে তায়াম্মুম বৈধ নয় ।
২৩। যদি এমন কোন পুরু তক্তার এক পিঠে নাজাসাত লাগে যে, সেটাকে মাঝখান থেকে চিড়ে দু’ভাগ করা যায়, তবে ঐ তক্তার অপর পিঠে দাড়িয়ে নামায পড়া জায়েয ৷ কিন্তু তক্তা যদি এরূপ পাতলা হয় যে, মাঝ খান থেকে চিড়ে দু'ভাগ করা সম্ভব নয় । তবে ঐ তক্তার ওপর দাড়িয়ে নামায পড়া বৈধ নয় ।
২৪। দেহে বা কাপড়ে আলকাতরা লাগলে তা নিয়ে নামায পড়া বৈধ নয়, যেহেতু আলকাতরা পবিত্র বস্তু নয় ।
২৫। হালাল জীবের পঁচা ডিম পবিত্র ।
২৬। জীবিত ব্যক্তির মুখের লালা পবিত্র, মৃতের লালা পবিত্র নয় ।
২৭। মানুষের কফ সর্দি কাশি অপবিত্র নয় । তা কাপড়-চোপড় বা শরীরে লাগলে তা নিয়ে নামায বৈধ ।
২৮। কুকুরের দেহ বা পশম অপবিত্র না হলেও তার ভেজা দেহ অপবিত্র । অতএব তাদের ভেজা দেহের সাথে কাপড় চোপড় লাগলে তা নিয়ে নামায আদায় করা জায়েয নয় ।
২৯। মাছের বিষ্ঠা পবিত্র । তা শরীর বা কাপড়ে লাগলে ধুয়ে নামায পড়া যায় ৷
৩০। বমি নাপাক বস্তু । সেটা শরীর বা কাপড়ে লাগলে ধুয়ে ফেলে নামায আদায় করতে হয় ।
৩১। বাঘের চর্বি নাপাক ৷ যে কান রোগ ব্যধিতে তা শরীরে মালিশ করলে রগড়িয়ে ধুয়ে উঠিয়ে নামায আদায় করতে হয় ।
৩২। মানুষ, শুকর এবং সাপ ছাড়া অন্য যে কোন জন্তুর চামড়া শুকিয়ে দাবাগত করে তার ওপর নামায আদায় করা যায় (যেহেতু সেগুলোর চামড়া ভালভাবে শুকালে পবিত্র হয়ে যায়) ৷
৩৩। গোয়াল ঘরে কিংবা পায়খানার ছাদে যদি নাজসাত না থাকে তবে দাড়িয়ে নামায পড়লে মাকরূহের সাথে নামায আদায় হবে ।