কারবালা প্রান্তরে ইমাম হুসাইন (رضي الله عنه)র অসহায় অবস্থার বর্ণনা

কারবালা প্রান্তরে ইমাম হুসাইন (رضي الله عنه)র অসহায় অবস্থার বর্ণনা

কারবালা প্রান্তরে ইমাম হুসাইন (رضي الله عنه)র অসহায় অবস্থার বর্ণনা


মক্কায় ইমাম হুসাইন (رضي الله عنه)

হুসাইন (رضي الله عنه) পরিবার-পরিজন নিয়ে মক্কায় চলে গিয়েছিলেন। এদিকে কুফাবাসীরা তাকে তাদের কাছে যাবার জন্য তাগাদা দিতে লাগল। তারা বলল, আমরা এক লাখ লােক আপনার সাথে আছি।' ইউনুস ইবন আবু ইসহাক বলেন, কুফাবাসীরা যখন জানতে পারল যে, হুসাইন (رضي الله عنه) মক্কায় এসেছেন এবং ইয়াযিদের বাইয়াত গ্রহণ করেননি, তখন তাঁর কাছে তাদের একটি প্রতিনিধি দল গেল। সুলাইমান ইবন সারদ ও মুসাইয়্যাব ইবন নাজাবা চিঠি লিখলেন। এছাড়া মদিনার একদল গণ্যমান্য ব্যক্তিও তাকে নিজের নামে বাইয়াত করাতে এবং ইয়াযিদকে প্রত্যাখ্যান করার আহ্বান জানিয়েছিলেন।


তারা বলছিলেন, ‘আমরা লােকদের এমনভাবে রেখে এসেছি, যে তারা আপনার দিকে তাকিয়ে আছে। আমরা আশা করি আপনার মাধ্যমে আল্লাহ আমাদের হকের উপর জমায়েত করবেন; তারা যে অত্যাচার করছে, সেগুলাে থেকেও আপনার মাধ্যমে তাদেরকে নিবৃত্ত করাবেন। খিলাফতের জন্য আপনিই ইয়াযিদের চেয়ে বেশি হকদার। সে উম্মতের খিলাফত


জবরদখল করেছে, হত্যা করেছে উম্মতের শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিদেরকে। তিনি মুসলিম ইবন আকিলকে ডেকে বললেন, কুফায় যাও। তাদের ভেতর ঐক্যবদ্ধতা দেখলে আমাকে চিঠি লিখে জানাবে। জীবনীকারগণ লিখেছেন, হুসাইন (رضي الله عنه) মুসলিমকে কুফায় পাঠালে এ খবর ইয়াযিদের কাছেও পৌঁছল। এরপর সে উবায়দুল্লাহ ইবন যিয়াদকে কুফার গভর্নর হিসেবে নিয়ােগ করল। ইয়াযিদ তার কাছে চিঠি লিখল, ‘আমি খবর পেলাম হুসাইন ইরাকের দিকে রওয়ানা হয়েছেন। তার উপর নজর রাখাে, সশস্ত্র সৈন্য প্রস্তুত রাখাে। সতর্ক থাকো। সন্দেহ হলে তাকে আটক করাে, অপবাদ দেয়া হলেও গ্রেফতার করাে।


এদিকে মুসলিম ইবন আকিল হুসাইন (رضي الله عنه)কে চিঠি লিখলেন, “তেরাে হাজার লােক আমার কাছে বাইয়াত করেছে। আপনি দ্রুত আসুন। হুসাইন (رضي الله عنه) কুফায় রওয়ানা হলেন। এদিকে উবায়দুল্লাহ ইবন যিয়াদ হযরত মুসলিম ইবন আকিলকে পাকড়াও করে হত্যা করে ফেলল। ইতােমধ্যে কায়স ইবন মুসহিরকে হুসাইন (رضي الله عنه) মুসলিম ইবন আকিলের কাছে পাঠিয়েছিলেন। মুসলিমের মৃত্যুর খবর তখনও তার অজানা। উবায়দুল্লাহ ইবন যিয়াদ তাকে ধরে ফেলল। তাকে বলল, “লােকদের সামনে দাঁড়িয়ে মিথ্যুকের ছেলে মিথ্যুক গালিগালাজ করাে। একথা বলে সে ইমাম হুসাইনকে বুঝিয়েছিল। কিন্তু কায়স বক্তৃতা দিতে দাঁড়িয়ে বললেন, “হে মানুষ! আমি হুসাইনকে উষর প্রান্তরে ছেড়ে এসেছি। তিনি তােমাদের কাছে সাহায্য কামনা করেছেন।' তখন উবায়দুল্লাহ তাকে হত্যা করার আদেশ দিল। তাকে দুর্গের চূড়া থেকে ফেলে দেয়া হলাে। এতেই তিনি ইন্তিকাল করেন। এদিকে মুসলিম ইবন আকিলের হত্যার সংবাদ হুসাইন (رضي الله عنه)'র কাছে পৌঁছল। তিনি ফিরে যেতে চেয়েছিলেন। {হুসাইন রাদিয়াল্লাহু সে সময় ফিরে যেতে চেয়েছিলেন এই মর্মে অন্য কোনাে বর্ণনা আমি ইতিহাসের বইগুলােতে পাইনি- অনুবাদক।}

তাঁর সাথে বানু আকিলের পাঁচজন সদস্য ছিল। তারা বলল, 'আপনি ফিরে যাবেন, অথচ আমাদের ভাই নিহত হয়েছে!' ইমাম হুসাইন (رضي الله عنه) ঘােড়র কাছে চলে আসলেন। এরপর বললেন, ‘তােমাদের চিঠিগুলাে না আসা পর্যন্ত আমি তােমাদের কাছে আসিনি।' তারা বলল, আমরা নিজেরাও বুঝিনি আমরা কী বলছি!' ইমাম হুসাইন (رضي الله عنه) এরপর কারবালার দিকে ফিরে চললেন। তার সাথে তখন ৪৫ জন অশ্বারােহী আর প্রায় একশাে জন পদাতিক সঙ্গী ছিল। এরপর উবায়দুল্লাহ ইবন যিয়াদ উমর ইবন সাদ ইবন আবি ওয়াক্কাসকে সেনাপতি নিযুক্ত করল। সে এসে ডাকল, 'হুসাইন!' হুসাইন (رضي الله عنه) বললেন, 'হয় তুমি আমাকে ছেড়ে দেবে, তাহলে আমি সীমান্ত এলাকায় অথবা যেখান থেকে এসেছি, সেখানে চলে যাব। নয়তাে ইয়াযিদের কাছে আমাকে নিয়ে যাবে।

{ইয়াযিদের কাছে নিয়ে যাবার কথা ইমাম হুসাইন (رضي الله عنه) বলেছিলেন কি না, তা নিয়ে মতপার্থক্য আছে। উকবা ইবন সামআন মদিনা থেকে কারবালা পর্যন্ত হুসাইন (رضي الله عنه)'র সফরসঙ্গী ছিলেন। তিনি বলেছেন, আমি হুসাইন (رضي الله عنه)'র সবগুলাে ভাষণ শুনেছি। তিনি কখনাে ইয়াযিদের হাতে হাত রাখার কথা বলেন নি। মােটকথা, ইবন সামআনের মতে, হুসাইন (رضي الله عنه) বলেছিলেন, তাঁকে যেন মদিনায় ফিরে যেতে অথবা সীমান্ত এলাকাগুলাের কোনাে একটায় চলে যেতে দেয়া হয়। (ইবনুল আসির, প্রাগুক্ত, খ, ৩, পৃ. ৪১৩)।}

উমর ইবন সাদ একথা উবায়দুল্লাহ ইবন যিয়াদকে লিখে পাঠাল।

কিন্তু ইবন যিয়াদ তখন জবাব দিল যে, না। যতক্ষণ না তিনি আমার হাতে হাত না রাখেন, আমার তাতে কোনাে সম্মান নেই। তিনি যদি অস্বীকার করেন, তবে তার সাথে যুদ্ধ করবে। তিনি নিহত হলে ঘােড়দৌড় করিয়ে তার বুককে পদপিষ্ট করবে। তখন আবৃত্তি করবে,

ألان حين تعلقته حبالنا + يرجو الخلاص ولات حين مناص

সাবধান! যখন আমাদের ফাদ তাকে জড়িয়ে ধরেছে, তিনি তখন মুক্তির আশা করেছেন, অথচ বাঁচার আর সময় নেই।'

{কারবালা প্রান্তরে ইমাম হুসাইন (رضي الله عنه)র অসহায় অবস্থা নিয়ে বিদ্রুপ করে দুরাত্মা ইবন যিয়াদ এ উক্তি করেছে। তার কবিতার মর্মার্থ হলাে, একবার যেহেতু মরুভূমিতে এসে ইমাম হুসাইন (رضي الله عنه) তাদের ফাঁদে আটকা পড়েছেন, তিনি ফিরে যেতে চাইলেও আর যেতে দেয়া হবে না।}


কিন্তু হুসাইন (رضي الله عنه) সাফ জানিয়ে দিলেন, আমি কখনাে উবায়দুল্লাহর হাতে হাত রাখব না।'

তিনি সঙ্গীদেরকে বললেন, আজ রাতেই তােমরা অন্ধকারে ছড়িয়ে পড়াে, আমাকে রেখে যাও।'

তারা বললেন, আপনার যা হবে, আমাদেরও তাই হবে। আল্লাহর কসম! সে পর্যন্ত আমরা আপনাকে ছেড়ে যাব না।'

এদিকে সৈন্যরা তাঁদের পানির মাঝে বাধা হয়ে দাঁড়াল। ইমাম হুসাইন (رضي الله عنه) তখন বললেন,

“হে আমার জাতি! আমাকে মেরে ফেলা কি তােমাদের শােভা পায়? আমার রক্ত কি তােমাদের জন্য বৈধ? আমি কি তােমাদের রসুলুল্লাহ (ﷺ)'র কন্যার পুত্র নই? আমি কি তার চাচাতাে ভাইয়ের পুত্র নই? এই দুজন জান্নাতবাসী যুবকদের নেতা’—আমি আর আমার ভাইয়ের ব্যাপারে রসুলুল্লাহ (ﷺ) এর এ বাণী কী তােমরা শােন নি? আমার কথা বিশ্বাস করলে ভালাে। নয়তাে তােমরা জাবির ইবন আব্দুল্লাহ, আবু সাঈদ, যায়দ ইবন আরকাম—এঁদেরকে জিজ্ঞেস করাে।'


তখন শিমার বলল, আমি দ্বিধা-সংশয় নিয়ে আল্লাহর ইবাদত করি। আপনি কী বলছেন, তা যদি আমি বুঝতে পারতাম!' উমর ইবন সাদ সর্বপ্রথম হুসাইন (رضي الله عنه)'র বাহিনীর উপর তীর ছুড়ল। তখন আলি ইবন হুসাইন (رضي الله عنه) যুদ্ধ করতে বের হলেন। তিনি আবৃত্তি করছিলেন,

أنا علي بن الحسين بن علي نحن وبيت الله أولى بالنبي من شمر وعمر وابن الدعي

‘আমি আলি ইবন হুসাইন ইবন আলি। বায়তুল্লাহর কসম! আমরাই নবিজীর সবচেয়ে আপন

শিমার, উমর আর পিতৃপরিচয়হীন লােকটি কে এখানে?”

{অর্থাৎ শিমর ইবন যিল যওশন, উমর ইবন সাদ ও উবায়দুল্লাহ ইবন যিয়াদ এর মতাে লােকদের স্থান কোথায়?}


এক লােক তাকে আঘাত করল। তিনি শহিদ হয়ে গেলেন। তিনি ছিলেন আলি আল আকবর। হুসাইন (رضي الله عنه)র পরিবারের একটি ছেলে এসে তার কোলে বসল। এক লােকের ছােড়া তীরে সেই শিশুটিও শহিদ হলাে। হুসাইন (رضي الله عنه) পানি খাবার জন্য পানি আনতে বললেন। পানি নিয়ে আসা হলাে। তিনি পানের ইচ্ছা করা মাত্রই হাসিন ইবন নুমায়র তীর ছুড়ল। সেই তীর তাঁর চোয়ালে বিদ্ধ হলাে। তিনি সেই রক্ত অঞ্জলি ভরে হাতে নিলেন। এভাবে ইমাম হুসাইন রাদিয়াল্লাহুর পরিবারের সবাইকেই শহিদ করা হলাে। পুরুষদের মধ্যে কেবল তিনি একাই অবশিষ্ট ছিলেন।

{হুসাইন (رضي الله عنه) একা একাই লড়াই করে যাচ্ছিলেন। শিমারসহ অশ্বারােহীর দল চারদিক থেকে তাকে আক্রমণ করছিল। তিনি একাকী তরবারি চালাচ্ছিলেন। তাবারিসহ অন্যান্য ইতিহাসগ্রন্থে বলা হয়েছে, হিংস্র নেকড়ে আক্রমণে যেভাবে ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়, ঠিক সেভাবেই তারা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ছিল। সবশেষে শিমার সবাইকে একযােগে আক্রমণে প্ররােচিত করে।}

অবশেষে ঘুরআহ ইবন শুরায়ক তার কাঁধে আঘাত হানল। আরেকজন আঘাত করল তার কাঁধের হাড়ের জোড়ায়। অবশেষে সিনান ইবন আনাস এসে তাঁর কণ্ঠার হাড়ে, এরপর তার বুকে বর্শাঘাত করল। তিনি মাটিতে পড়ে গেলেন। তখন সে নেমে এসে হুসাইন (رضي الله عنه)কে জবাই করল, তার মাথা কেটে বিচ্ছিন্ন করে ফেলল। কেউ কেউ বলেছেন, তার মাথা বিচ্ছিন্ন করেছিলেন খাওলা বিন ইয়াযিদ। তার শরীরে ৩৩ টি বর্শাঘাতের চিহ্ন দেখা গিয়েছিল। তার কাপড়ে তীরের জন্যই ছিদ্র হয়েছিল ১১৯ টি। এরপর তারা ইমাম হুসাইন (رضي الله عنه)'র অস্ত্রশস্ত্র ও পরিধেয় বস্ত্রও নিয়ে নিয়েছিল। তার তরবারি কালাফিস আন নাহশি নিয়ে নেয়। বাহর ইবনে কাব তার পাজামা খুলে নিয়ে তাকে বস্ত্রহীন করে ফেলে রাখে। {এসব দুরাত্মা পাপিষ্টের উপর কিয়ামত পর্যন্ত আল্লাহর লানত বর্ষিত হােক- অনুবাদক}

কায়স ইবন আশআস তার জামা খুলে নেয়। ইমাম হুসাইন (رضي الله عنه)'র পাগড়ি এবং ফাতিমা বিনত হুসাইনের (মূল পােশাকের উপর পরিধেয় বাড়তি কাপড় জাবির ইবন ইয়ায়িদ ছিনিয়ে নেয়। আরেকজন ফাতিমা বিনত হুসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহার অলঙ্কারগুলাে নিয়ে নেয়। 

এরপর উমর ইবন ইয়াযিদ ঘােষণা দিল, যে হুসাইনের মাথা নিয়ে আসবে, তাকে এক হাজার দিরহাম দেয়া হবে। সে আরও বলল, “কে ঘােড়া দিয়ে হুসাইনের লাশকে পদপিষ্ট করে আসবে? একদল লােক নিজেদের ঘােড়া নিয়ে এসে তার শরীরকে পদদলিত করে [মাটির সাথে মিশিয়ে দিল। উমর ইবন সাদ এবার হুসাইন (رضي الله عنه)'র মাথাকে উবায়দুল্লাহ ইবন যিয়াদের কাছে পাঠিয়ে দিল। তার সাথে শিশু আর নারীদেরকেও বাহনে উঠানাে হলাে। {তাঁদেরকে কুফায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল।} তাদের কাফেলা যখন শহিদদের লাশের পাশ দিয়ে অতিক্রম করছিল, তখন যয়নব বিনতে আলি রাদিয়াল্লাহু আনহু চিৎকার করে বলে ওঠেন :

‘ও মুহাম্মদ! ও মুহাম্মদ! (সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) হুসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহুর এই উন্মুক্ত প্রান্তরে ছিন্নভিন্ন রক্তস্নাত দেহে পড়ে আছে। ও মুহাম্মদ! (সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আপনার কন্যারা আজ যুদ্ধবন্দি আর বংশধরেরা সবাই মৃত। তাঁদের উপর দিয়ে পূবালি বাতাস বয়ে চলেছে।

একথা শুনে শত্রু-মিত্র সবাই কেঁদে ফেলেছিল। কুফার অলিতে গলিতে হুসাইন (رضي الله عنه)'র মাথা প্রদক্ষিণ করানাে হলাে। এরপর ইবন যিয়াদ তাঁর মাথাকে (বর্শার ডগায়] বিদ্ধ করতে বলল। যর ইবন হুবায়শ বলেন, হুসাইনের মাথাই সর্বপ্রথম বর্শার ডগায় বিদ্ধ করা হয়।

❏ মুহাম্মদ ইবন সিরিন বর্ণনা করেন, আনাস ইবন মালিক (رضي الله عنه) বলেন, উবায়দুল্লাহ ইবন যিয়াদের কাছে হুসাইন (رضي الله عنه)'র মাথা এনে একটি পাত্রের উপর রাখা হলাে। এরপর সে তার সৌন্দর্যের ব্যাপারে মন্তব্য করল। তখন আনাস বললেন,

كان أشبههم برسول الله صلى الله عليه وسلم

‘আকৃতির দিক থেকে রসুলুল্লাহ (ﷺ) এর সাথে তার সাদৃশ্য ছিল সবচেয়ে বেশি।' হুসাইন (رضي الله عنه)'র (চুল-দাড়িতে) তখন ওয়াসমা দ্বারা কলপ লাগানাে ছিল। {ইমাম বুখারি, প্রাগুক্ত, কিতাব : ফাদাউলু আসহাবিন নাবি (ﷺ), বাব : মানাকিবুল হাসান ওয়াল হুসাইন (رضي الله عنه)। }


আনাস ইবন মালিক রাদিয়াল্লাহু আনহু রা: থেকে আরও বর্ণিত আছে, হুসাইনের মাথা এনে যখন একটি পাত্রের উপর রাখা হয়, তখন আমি ইবন যিয়াদকে দেখতেছিলাম। সে হাতের একটি ছুরি দিয়ে তাঁর দাঁতের উপর খোঁচা দিতে লাগল বলতে লাগল, ইনি আসলেই অত্যন্ত সুপুরুষ।' আমি বললাম,  

والله لأسوءنك لقد رأيت رسول الله صلى الله عليه وس موضع قضيبك من فيها

আল্লাহর কসম! আমি অবশ্যই তােমাকে নিবৃত্ত করব। তাঁর মুখে যেখানে তুমি ছুরি রেখেছ, আল্লাহর রসুলকে সেখানে চুমু দিতে দেখেছি আমি।৩৭

{ইমাম আহমদ ইবন হাম্বল, ফাদাইলুস সাহাবা, ফাদাইলুল হাসান রাদিয়াল্লাহু আনহ}


মিরদাস তার বাবা থেকে এবং তিনি সাঈদ ইবন মুয়ায এবং আমর ইবন সাহল—এ দুজন থেকে বর্ণনা করেন, তারা দুজন উবায়দুল্লাহ ইবন যিয়াদের কাছে ছিল। তখন সে হাতের ছড়ি দিয়ে হুসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহুর নাক ও দুচোখে খোচা দিল, তার মুখেও আঘাত করল। 

তখন যায়দ ইবন আরকাম রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেন, “তােমার ছড়ি সরিয়ে নাও। তুমি যেখানে ছড়ি রেখেছ, আমি সেখানে রসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে তাঁর ঠোট রাখতে দেখেছি। ইবন যিয়াদ বলল, বুড়াে হয়ে তােমার ভীমরতি হয়েছে, মতিভ্রম হয়েছে।' যায়দ তখন বললেন, “তােমাকে অবশ্যই এমন একটি হাদিস শুনাব, যা তােমার জন্য এরচেয়েও দুঃসহ। আমি রসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে দেখেছি, তিনি তাঁর ডান উরুর উপর হাসানকে এবং বাম উরুর উপর হুসাইনকে বসিয়েছেন। এরপর তাঁর হাত তাদের দুজনের মাথার উপর রেখে বলেছেন,

اللهم إني أستودعك إياهما وصالح المؤمنين

‘হে আল্লাহ। আমি তাদেরকে আপনার কাছে ও নেককার মুমিনদের কাছে সােপর্দ করছি।'

তােমার কাছে আল্লাহর রসুলের রেখে যাওয়া আমানতের কী অবস্থা করেছ? হিশাম ইবন মুহাম্মদ আযদের জনৈক শায়খের সূত্রে বর্ণনা করেছেন, ইবন যিয়াদের কাছে হুসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহুর কর্তিত শির এবং তার সাথে তার পরিবারবর্গ, সন্তান-সন্ততি আর বােনদেরকে নিয়ে আসা হলাে। যয়নব বিনত আলি রাদিয়াল্লাহু আনহা তখন তাঁর সবচেয়ে মলিন পােশাক পরে ছদ্মবেশ নিয়েছিলেন। অন্য নারীরা তাঁকে ঘিরে রেখেছিল। ইবন যিয়াদ বলল, ইনি কে? কিন্তু তিনি কোনাে প্রত্যুত্তর করলেন না। ইবন যিয়াদ একই প্রশ্ন তিনবার করল। তিনি একবারও জবাব দিলেন না। শেষপর্যন্ত জনৈক নারী বললেন, ইনি হলেন আলি ইবন আবু তালিব রাদিয়াল্লাহু আনহুর কন্যা।

তখন ইবন যিয়াদ বলল, “আলহামদুলিল্লাহ। তিনি তােমাদের লাঞ্চিত হত্যা করেছেন এবং তােমাদের অতিশয়ােক্তি মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছেন। যয়নব রাদিয়াল্লাহু আনহা বলে উঠলেন, “আলহামদুলিল্লাহ। তিনি আমাদেরকে মুহাম্মদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মাধ্যমে সম্মানিত করেছেন, উত্তমভাবে আমাদের পবিত্র করেছেন। তুমি যা বলছ, তা ঠিক নয়। আল্লাহ তাকেই লাঞ্চিত করেন, যে পাপিষ্ঠ। 

আল্লাহ তাকেই মিথ্যা প্রতিপন্ন করেন, যে অপরাধী। ইবন যিয়াদ বলল, তােমাদের পরিবারের সাথে আল্লাহ কেমন ব্যবহার করেছেন তা তাে দেখলে। যয়নব রাদিয়াল্লাহু আনহা বললেন, আল্লাহ তাদের জন্য নিহত হওয়া নির্ধারণ করে রেখেছিলেন। এজন্য তারা তাদের বধ্যভূমিতে লড়াইয়ের জন্য উপস্থিত হয়েছেন। আল্লাহ খুব দ্রুতই তাদের সাথে তােমাকে একত্রিত করবেন। এরপর তারা আল্লাহর কাছে তােমাকে নিয়ে বিচার দেবেন। হুমায়দ ইবন মুসলিম বলেন, উবায়দুল্লাহ ইবন যিয়াদ আমাদের উদ্দেশে একটি ভাষণ দিয়েছিল। তাতে সে বলেছিল,

‘আল্লাহর প্রশংসা করছি, যিনি হককে এবং হকপন্থীদেরকে বিজয়ী করেছেন; যিনি আমিরুল মুমিনিন ও তার দলকে সাহায্য করেছেন এবং মিথ্যুকের ছেলে মিথ্যুককে সদলবলে হত্যা করেছেন।

একথা শুনে আব্দুল্লাহ ইবন আফিফ আল আযদি দাঁড়িয়ে গেলেন। বললেন, “ওহে মারজানার পুত্র! মিথুকের বাচ্চা মিথুক হলাে তুমি নিজে, তােমার বাবা এবং যে তােমাকে গভর্নর বানিয়েছে।'



হাসান বসরির কাছে হুসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহুর হত্যাকাণ্ডের সংবাদ পৌঁছলে তিনি কেঁদেছিলেন। কান্নার তােড়ে তাঁর দুকাধ কাঁপছিল। তিনি বলছিলেন, সেই উম্মতের জন্য লাঞ্ছনা! যে উম্মতের নবির সন্তানকে পিতৃপরিচয়হীন ব্যক্তি হত্যা করে।

{উবায়দুল্লাহ ইবন যিয়াদের পিতা যিয়াদের পিতৃপরিচয় নিশ্চিত হওয়া যায়নি। এজন্য তা যিয়াদ ইবন আবিহ নামে ডাকা হতাে। এদিক থেকে উবায়দুল্লাহ ইবন যিয়াদের কে বংশ পরিচয় নেই।}

রাবি ইবন খাইসাম বললেন, 'তারা সেই শিশুটিকে হত্যা করেছেন, সফর থেকে ফিরলে রসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যাকে [বুকের সাথে জড়িয়ে ধরতেন।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Be alert before spamming comments.

নবীনতর পূর্বতন

Sponsored

Responsive Ad