নরমাল ডেলিভারি চাইলে কী করবেন?
কোনো নারীই এমন নেই যে কিনা মাতৃত্বের স্বাদ নিতে চায় না। সবাই চায় শিশুটি সুস্থভাবে পৃথিবীতে আসুক। সব নারীই চায় নবজাতক প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ায় পৃথিবীর আলো দেখুক। কিন্তু বর্তমানে অধিকাংশেরই স্বাভাবিক প্রসব হয় না। অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে শিশুর জন্ম হয়।
নরমাল ডেলিভারি চাইলে করণীয় কী, সে সম্পর্কে বিস্তারিত জানিয়েছেন বি আই এইচ এস জেনারেল হাসপাতালের ফার্টিলিটি কনসালট্যান্ট ও গাইনোকোলজিস্ট ডা. হাসনা হোসেন আঁখি।
* প্রেগনেন্সি হতে হবে পূর্ব পরিকল্পিত : এক্ষেত্রে জটিলতা কম হয়। সবকিছু নিয়ন্ত্রিত থাকে। গর্ভধারণের তিন মাস আগে থেকে গাইনোকোলজিস্টের শরণাপন্ন হতে হয়। এ সময় তার শারীরিক অবস্থা জানা যায়, গর্ভধারণের কোনো জটিলতা আছে কিনা সেগুলো নির্ণয় করা হয় এবং চিকিৎসাও দেওয়া যায়। ফলে গর্ভধারণের জটিলতাগুলো এড়ানো সম্ভব হয়।
* সঠিক বয়সে গর্ভধারণ : মেয়েদের গর্ভধারণের উপযুক্ত বয়স হচ্ছে ২০ থেকে ৩৫ বছর। এ সময় জটিলতা কম হয় এবং নরমাল ডেলিভারি সহজ হয়।
* উপযুক্ত বিএমআই : উচ্চতা এবং ওজন নরমাল ডেলিভারির ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। সঠিক বিএমআই থাকলে নরমাল ডেলিভারি সহজ হয়।
* নিয়মিত এন্টিনেটাল চেকআপ : নিয়মিত এন্টিনেটাল চেকআপে রোগীর ওজন, প্রেসার, হিমোগ্লোবিন, ব্লাড সুগার, বাচ্চার মুভমেন্ট, বাচ্চার ওজন বৃদ্ধি-সবকিছু দেখা যায়। এর ফলে কোথাও কোনো ব্যত্যয় হলে সে অনুযায়ী ব্যবস্থাও নেওয়া যায়।
* শরীর চর্চা : নিয়মিত শারীরিক ব্যায়াম, ইয়োগা ও ব্রিদিং এক্সারসাইজের মাধ্যমে নিজেকে ফিট রাখা জরুরি। ফলে গর্ভবতীরা লেবার পেইনের তীব্রতাকে সহ্য করতে পারে। বিশেষ করে ব্রিদিং এক্সারসাইজ এবং ইয়োগা নরমাল ডেলিভারির জন্য কার্যকরী একটি পদ্ধতি।
* সুষম খাদ্যাভ্যাস : পুষ্টিকর ও সুষম খাদ্যাভ্যাসের মাধ্যমে শরীরের শক্তি সঞ্চয় করে রাখা জরুরি। বিশেষ করে হিমোগ্লোবিন সঠিক পরিমাণে রাখা এবং প্রাণশক্তি বজায় রাখা নরমাল ডেলিভারির জন্য প্রয়োজন।
* আনুষঙ্গিক রোগ নিয়ন্ত্রণে রাখা : গর্ভাবস্থায় অনেকেরই নতুন উপসর্গ তৈরি হয়, যেমন ডায়াবেটিস, হাই ব্লাড প্রেসার। এগুলো নিয়ন্ত্রণে রাখা জরুরি। এগুলো নিয়ন্ত্রণে না থাকলে নরমাল ডেলিভারি করা অনেক সময় অসম্ভব হয়ে পড়ে।
* গর্ভকালীন জটিলতা থেকে মুক্ত থাকা : গর্ভাবস্থায় অনেক ধরনের জটিলতা তৈরি হতে পারে, যেমন গর্ভফুল নিচে থাকা, বাচ্চার ওজন কম থাকা, হঠাৎ করে পানি ভেঙে যাওয়া। এসব সমস্যা থাকলে নরমাল ডেলিভারি করা যায় না।
* মনোবল ঠিক থাকা : নরমাল ডেলিভারির জন্য মানসিক শক্তি একান্ত জরুরি। বিশেষ করে ডেলিভারির ব্যথা সহ্য করার ক্ষমতা থাকতে হবে।
* ব্যথামুক্ত নরমাল ডেলিভারি : ইপিডুরাল এনালজেসিয়ারের মাধ্যমে খুব সহজেই নরমাল ডেলিভারি করা সম্ভব। যদিও একটু ব্যয়বহুল। বাংলাদেশের বড় হাসপাতালগুলোতে ব্যথামুক্ত নরমাল ডেলিভারির ব্যবস্থা আছে।
সুত্র - যুগান্তর
জীবনযাপনে পরিবর্তনের মাধ্যমে নরমাল ডেলিভারি করা সম্ভব
যদি কেউ গর্ভবতী হয় তবে সে শুয়ে থাকতে পারবে না। সংসারের স্বাভাবিক কাজগুলো সে করবে। সে তার পড়াশোনা চালিয়ে যাবে। তাকে তার অফিস, তার কলেজ এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তার জীবনধারা পরিবর্তন করতে হবে। আগে তার যদি মাঝরাতে ঘুমানোর অভ্যাস থাকে, দুপুর ১২টায় ঘুম থেকে ওঠে, এগুলো বদলাতে হবে। সারারাত বসে থাকা, মোবাইল টেপা বা ফেসবুকিং করার এসব অভ্যাস তাকে বদলাতে হবে। তাকে খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠতে হবে ; অন্তত সকালে তার আধা ঘণ্টা হাঁটা উচিত।
একজন গর্ভবতী মহিলাকে সকালে ৮ টায় নাস্তা করা উচিত এবং বিকেলে দুই ঘন্টা বিশ্রাম নেওয়া উচিত। এবং তাকে রাতে আট ঘন্টা ঘুমানো উচিত। সেক্ষেত্রে সবাইকে বলছি রাত ১০টার মধ্যে খাওয়া-দাওয়া শেষ করে মোবাইল ইন্টারনেট বন্ধ করে ঘুমাতে যাওয়া উচিত । তাহলে অন্তত ১১/১২টার মধ্যে ঘুম আসবে এবং তিনি সহজেই আট ঘণ্টা ঘুম নিশ্চিত করতে পারবেন। জীবনধারা পরিবর্তন খুবই গুরুত্বপূর্ণ ।
খাদ্যাভ্যাস
দ্বিতীয়টি হল ডায়েট। আমাদের মেয়েদের মধ্যে খাদ্যাভ্যাস খুবই খারাপ। তারা ফাস্ট ফুড খাওয়ার প্রবণতা রাখে; অনেকেই আছে যাদের বুফে খাওয়ার প্রবনতা বেশি, তবে গর্ভাবস্থায় এই জিনিসগুলি এড়িয়ে চলা উচিত। গর্ভাবস্থায় খাবার ঘরে রান্না করা এবং তাজা খাবার হওয়া উচিত এবং তা সময়মত খাবে। গর্ভাবস্থার প্রথম দিকে একজন ডায়েটিশিয়ানের সাথে পরামর্শ করা ভাল। ডায়েটিশিয়ান তার শরীরের ওজন, উচ্চতা হিসেব করে তাকে আদর্শ ক্যালোরি সম্পর্কে ধারণা এবং তাকে একটি ডায়েট চার্ট দেন। তাকে সেই ডায়েট চার্ট কঠোরভাবে অনুসরণ করতে হবে।
এমন অনেক প্যাশেন্ট আমি দেখেছি যে, ডায়েট চার্ট আমি ঠিকই দিই, কিন্তু ডায়েট চার্টটাও রেখে দেয়, সেই সঙ্গে তার সঙ্গে এক্সট্রা যে খাবারগুলো, তার মন চাইলে ফুচকা খেতে যাচ্ছে, মন চাইলে ফাস্ট ফুড খেতে যাচ্ছে। এই জিনিসগুলো সে করে ফেলে। বাইরের খাবারের দুটি সমস্যা। একটা হচ্ছে অতিরিক্ত কিলোক্যালরি গেইন করে; খুব সহজেই মোটা হয়ে যায়। একটা স্টেজে এসে তার ডায়াবেটিস হয়; হাইপ্রেশার হয় এবং তখন আমাদের জন্য নরমাল ডেলিভারি অ্যালাউ করাটা অনেক কষ্টের হয়ে যায়। অ্যাকচুয়ালি প্রেগন্যান্সিটাই মানে ডেট পর্যন্ত যাওয়াটা অনেক কষ্টের হয়ে যায়।
হাঁটাচলা
এখনকার মেয়েদের মধ্যে আরেকটা ব্যাপার খুব বেশি দেখি আমি। মেয়েরা হাঁটে না; হাঁটতে চায় না। ঘরের মধ্যেও তারা হাঁটে না। জিজ্ঞেস করলে বলে যে, হাঁটলে গরম লাগে; হাঁটলে কষ্ট হয়, কোথায় হাঁটব, এ ধরনের নানা অ্যাক্সকিউজ। আমাদের সবসময় হাঁটা চলার মধ্যে থাকতে হবে । ঘরেও হাঁটা চলা করা যায় । তো আমাদের হাঁটা চলার জন্য সকালের সময়টা আমরা নিবার্চন করতে পারি ।
লো কমোড ব্যবহার
আরেকটা টিপস আমি সবাইকে দিই। সেটা হচ্ছে যে আমাদের টয়লেট ব্যবহারটা। আমাদের সবার বাসায় কিন্তু এখন হাইকমোড ব্যবহার করে অভ্যস্ত। অনেকে ছোটবেলা থেকেই অভ্যস্ত। কারও পক্ষেই বাসার যে নিচু কমোড, সেই কমোডটাতে কিন্তু যাওয়া হয় না, কিন্তু প্রত্যেকের বাসায় একটা নিচু টয়লেট আছে।
আমি এ জন্য সবাইকেই বলি, তোমার প্রেগন্যান্সির শুরু থেকে অন্তত দিনে একবার টয়লেট করতে হলেও যদি ইউরিন করার জন্যও দরকার হয়, একবার হলেও সেই লো কমোড টয়লেটটাতে যাবে। এতে একটা খুব ভালো কিন্তু পেলভিসের এক্সারসাইজ হয়।
মানসিক প্রস্তুতি
আর যেটা সবাইকে বলি যে, মানসিকভাবে প্রস্তুতি যে, আমি পারব। আমি কেন পারব না? সবাই পারলে আমিও পারব। আমার মা পেরেছে, আমার নানি পেরেছে। আমি কেন পারব না? এই জিনিসটা তাদের মনের মধ্যে আনতে হবে। আর মন থেকে এটা ফেলে দিতে হবে যে, চেষ্টা করে দেখব। না পারলে সি-সেকশন করে ফেলব।
অল্টারনেটিভটা মাথায় আনা যাবে না যে, না পারলে সি-সেকশন তো আছেই। অল্টারনেটিভটা আসাতে, অল্টারনেটিভটা ইজিলি এভেইলেবল হওয়াতে আমাদের নরমাল ডেলিভারির রেটটা অ্যাকচুলয়ালি এতখানি কমে গেছে।
আরেকটা হচ্ছে যে, আমি দেখেছি, আমার প্যাশেন্টদের মধ্যে যারা একদম ডেট পর্যন্ত, হয়তো ডেটের আগের দিন পর্যন্ত অফিস করেছে কিংবা কলেজ করেছে, ভার্সিটি করেছে। এমনও প্যাশেন্ট দেখেছি যে, আড়ংয়ে গিয়ে শপিং-টপিং করে দুই ঘণ্টা হেঁটে আসার পরে বাসায় লেবার পেইন উঠেছে। আমার এখানে আসার পর খুব ইজি, হয়তো বা দুই-তিন ঘণ্টার মধ্যেই তার ডেলিভারি হয়ে গেছে।
এই জন্য অ্যাকটিভিটিটা খুব ইম্পরট্যান্ট যে, তাকে সবসময় চলাফেরার মধ্যেই থাকতে হবে। শুধু মুখে বলব আমি নরমাল ডেলিভারি করব, কিন্তু আমার ইচ্ছামতো খাব, আমি সারা দিন ঘরে এসি ছেড়ে নিজের রুমের ভেতরে শুয়ে থাকব, হয় মোবাইল বা ল্যাপটপ নিয়ে পড়ে থাকব। এ ধরনের লাইফস্টাইল মেন্টেইন করলে কিন্তু কোনোকিছুই পসিবল না। অ্যাকচুয়ালি একটা সুস্থ বাচ্চা জন্ম দেওয়া পসিবল না, নিজেও শেষ পর্যন্ত সুস্থ থাকা সম্ভব না।
এ কারণেই এখন আমাদের মায়েদের মধ্যে হাই ব্লাড প্রেশার, ডায়াবেটিস এগুলো খুব বেশি। দেখা যায় যে, আগে কখনোই ছিল না; প্রেগন্যান্সির মাঝখানের দিকে তারা এগুলোতে অ্যাটাক হচ্ছে।
সবাইকে বলব, লাইফস্টাইল বদলাতে হবে, ডায়েট বদলাতে হবে। একজন গর্ভবতীকে স্বাভাবিক কার্যক্রম পরিচালনা করা উচিত। এটা নিয়ে কোন চিন্তিত হওয়া যাবে না । নিজের মনোবলকে দৃঢ় করতে হবে এবং এটা ভাবতে হবে এটা আমার জীবনের একটি অংশ । শুরু থেকেই মানসিকভাবে ঠিক করতে হবে। তবেই সম্ভব।