মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী
মাওলানা ভাসানী অন্যতম রাজনৈতিক নেতা। সাধারণভাবে ভাসানী নামে সুপরিচিত। তাঁর পূর্ণনাম মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী।
১৮৮০ খ্রিষ্টাব্দের ১২ ডিসেম্বর, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী সিরাজগঞ্জের ধানপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম হাজী শরাফত আলী খান। অল্প বয়সে তিনি পিতামাতাকে হারান। এরপর তিনি ইব্রাহিম খান নামক এক চাচার আশ্রয়ে প্রতিপালিত হন। এই সময় তিনি স্থানীয় মাদ্রাসা থেকে শিক্ষা সমাপ্ত করেন। এরপর তিনি টাঙ্গাইলের কাগমারির একটি প্রাইমারি স্কুলে শিক্ষকতা শুরু করেন। পরে তিনি ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট এলাকার কালা গ্রামের একটি মাদ্রাসায় কিছুদিন শিক্ষকতা করেন।
এই সময় জমিদার-মহাজনদের অত্যাচার থেকে সাধারণ কৃষকদের রক্ষা করার জন্য আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা করেন। ফলে তাঁকে স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিদের বিরোধিতার কারণে কাগমারি ত্যাগ করে আসামের জলেশ্বরে চলে যান। ১৮৯৭ খ্রিষ্টাব্দে তিনি বোগাদাদের ইসলাম প্রচার মিশনের অধীনে পীর সৈয়দ নাসীরুদ্দীনের সাথে কাজ করেন। ১৯০৩ খ্রিষ্টাব্দে তিনি সশস্ত্র আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হন। ১৯০৭ খ্রিষ্টাব্দে তিনি পীর সাহেবের নির্দেশে ইসলামিক শিক্ষার উদ্দেশ্যে উত্তর ভারতের দেওবন্দ যান। দুই বছর সেখানে অধ্যয়ন করে আসামে ফিরে আসেন ১৯০৯ খ্রিষ্টাব্দের দিকে।
১৯৩৭ খ্রিষ্টাব্দে মাওলানা ভাসানী কংগ্রেস ত্যাগ করে মুসলিম লীগে যোগদান করেন। এসময় তিনি "আসাম চাষী মজুর সমিতি" গঠন করেন এবং ধুবরী, গোয়ালপাড়াসহ বিভিন্ন জায়গায় প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। এই সময় তিনি আসামের আইন সভায় নির্বাচিত সাংসদ (ধুবরি আসনের এমএলএ) নির্বাচিত হন।
১৯৪০ খ্রিষ্টাব্দে শের-এ-বাংলা এ.কে. ফজলুল হকের সঙ্গে মুসলিম লীগের লাহোর সম্মেলনে যোগদান করেন।
১৯৪৪ খ্রিষ্টাব্দে তিনি আসাম প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন।
১৯৪৫-৪৬ খ্রিষ্টাব্দে আসাম জুড়ে বাঙালিদের বিরুদ্ধে "বাঙ্গাল খেদাও" আন্দোলন শুরু হলে ব্যাপক দাঙ্গা দেখা দেয়। এসময় বাঙালিদের রক্ষার জন্য তিনি বারপেটা, গৌহাটিসহ আসামের বিভিন্ন জায়গা ঘুরে বেড়ান।
১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে ভৌগলিক সীমারেখা সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে আসামের মুখ্যমন্ত্রী স্যার মোহাম্মদ সাদউল্লাহর সাথে তাঁর বিরোধিতার সৃষ্টি হয়। আসাম সরকার ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দের শেষের দিকে গ্রেফতার করে। পরে আসাম ছেড়ে চলে যাওয়ার শর্তে তাঁকে মুক্তি দেওয়া হয়।
১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দে মুক্তি পেয়ে তিনি টাঙ্গাইলের সন্তোষে ফিরে আসেন। এই সময় এক উপনির্বাচনে মুসলিম লীগ প্রার্থী এবং করোটিয়ার জমিদার খুররম খান পন্নীকে পরাজিত করেন।
১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দে প্রথম দিকে তিনি বঙ্গীয় মুসলিম লীগের মনোনীত প্রার্থী হিসেবে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পূর্ববঙ্গ ব্যবস্থাপক সভার সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ মার্চ, ব্যবস্থাপক সভার কার্যাবলি বাংলায় পরিচালনা করার জন্য স্পিকারের কাছে দাবি জানান এবং এই দাবি নিয়ে পীড়াপীড়ি করেন। ১৯ মার্চ, বাজেট বক্তৃতায় অংশ নিয়ে বলেন, যেসব কর কেন্দ্রীয় সরকার পূর্ববঙ্গ প্রদেশ থেকে সংগ্রহ করে তার শতকরা ৭৫% প্রদেশকে দিতে হবে। উল্লেখ্য যে, ব্রিটিশ আমলে বঙ্গপ্রদেশ জুটেক্স ও সেলসট্যাক্স রাজস্ব হিসেবে আদায় করত এবং এই করের ভাগ কেন্দ্রীয় সরকারকে দিতে হতো না। পাকিস্তান সৃষ্টির পর কেন্দ্রীয় সরকার পূর্ববঙ্গ সরকারের হাত থেকে এই কর ছিনিয়ে নিয়ে নিজেরাই আদায় করা শুরু করে। এর ফলে পূর্ববঙ্গ সরকার আর্থিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছিল। এই সময় পূর্ববঙ্গ সরকারের বার্ষিক বাজেট ছিল মাত্র ৩৬ কোটি টাকা। সরকারের সমালোচনা করায় মুসলিম লীগের ক্ষমতাসীন সদস্যরা তাঁর নির্বাচনে ত্রুটির অজুহাত দেখিয়ে আদালতে মামলা দায়ের করে। শেষ পর্যন্ত ব্যবস্থাপক সভার সদস্য পদ থেকে পদত্যাগ করেন।
১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দে ৩০ জানুয়ারি, বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ঢাকা জেলার বার লাইব্রেরী হলে তার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক সভায় 'সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদ' গঠিত হয়। ২১ ফেব্রুয়ারির গুলির ঘটনায় তিনি তীব্র প্রতিবাদ করেন এবং ২৩ ফেব্রুয়ারিতে তাঁকে তাঁর গ্রামের বাড়ি থেকে গ্রেফতার করা হয়।
১৯৫৩ খ্রিষ্টাব্দের ২১ এপ্রিল তিনি জেল থেকে মুক্তি পান। ১৯৫৩ খ্রিষ্টাব্দের ৯ জুলাই' পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগে-এর কাউন্সিলে তিনি দলের সভাপতি হন এবং শেখ মুজিবর রহমান দলের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।
১৯১৪ খ্রিষ্টাব্দে পূর্ব বাংলা নেত্রকোণা এবং শেরপুর অঞ্চলের খ্রিষ্টান মিশনারীদের ধর্মান্তকরণ প্রক্রিয়ার তীব্র বিরোধিতা করেন।
১৯১৭ খ্রিষ্টাব্দে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস ময়মনসিংহ সফরে গেলে তাঁর ভাষণ শুনে ভাসানী অনুপ্রাণিত হন। এরপর তিনি দেশবন্ধুর ন্যাশনাল পার্টির সদস্য হন।
১৯১৯ খ্রিষ্টাব্দে তিনি মাওলানা মোহম্মদ আলীর অনুপ্রেরণায়, কংগ্রেসে যোগদান করেন। এই সময় অসহযোগ আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন।
১৯২০ খ্রিষ্টাব্দে এই আন্দোলনে অংশগ্রহণের জন্য তিনি গ্রেফতার হন এবং দশ মাস কারাদণ্ড ভোগ করেন। মুক্তি পাওয়ার পর তিনি খেলাফত আন্দোলনের সাথে জড়িয়ে পড়েন।
১৯২১ খ্রিষ্টাব্দে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের নেতৃত্বে অসহযোগ আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন।
১৯২৩ খ্রিষ্টাব্দে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন স্বরাজ্য পার্টি গঠন করলে, ভাসানী এই দলের সাথে যুক্ত হন এবং ওই দলকে সংগঠিত করার জন্য সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন।
১৯২৪ খ্রিষ্টাব্দে সিরাজগঞ্জে কংগ্রেসের বঙ্গীয় প্রাদেশিক সম্মেলনে, কৃষকদের উপর জমিদারদের অত্যাচারের বিষয় তুলে ধরেন। এই কারণে তাঁকে পুনরায় আসামে ফিরে যেতে হয়।
১৯২৬ খ্রিষ্টাব্দে আসামে প্রথম কৃষক-প্রজা আন্দোলনের সুত্রপাত ঘটান।
১৯২৯ খ্রিষ্টাব্দে আসামের ধুবড়ী জেলার ব্রহ্মপুত্র নদের ভাসান চরে প্রথম কৃষক সম্মেলন আয়োজন করেন। এখান থেকে তার নাম রাখা হয় "ভাসানী'র মাওলানা"। এরপর থেকে তার নামের শেষে ভাসানী শব্দ যুক্ত হয়।
১৯৩০ খ্রিষ্টাব্দে তিনি 'মুসলীম লীগ'-এর সাথে যোগযোগ হয়।
১৯৩১ খ্রিষ্টাব্দে সন্তোষের কাগমারীতে, ১৯৩২ খ্রিষ্টাব্দে সিরাজগঞ্জের কাওরাখোলায় এবং ১৯৩৩ খ্রিষ্টাব্দে গাইবান্ধায় বিশাল কৃষক সম্মেলন করেন।
১৯৩৫ খ্রিষ্টাব্দে আসামের স্থানীয় অধিবাসী (অহমিয়া) 'বঙালখেদা' আন্দোলনে ডাক দিলে, তিনি এর পাল্টা আন্দোলনের ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। সেই সময়ে আসামে 'লাইন প্রথা' চালু হলে এই নিপীড়নমূলক প্রথার বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেতৃত্ব দান করেন। উল্লেখ্য একটি সুনির্দিষ্ট সময়ের পরে যে সকল বাঙালি আসামে প্রবেশ করেছে তাদেরকে বহিষ্কার করাই ছিল 'লাইন প্রথা'র উদ্দেশ্য। ভাসানী এই লাইন প্রথার বিরোধিতা করেন। ভারত-পাকিস্তান বিভাজনের পূর্ব-কাল পর্যন্ত তিনি এই আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন।
এরপর পূর্ববঙ্গের তৎকালীন গভর্নর এক নির্বাহী আদেশ বলে মওলানা ভাসানীর নির্বাচন বাতিল করেন এবং একই সাথে ১৯৫০ খ্রিষ্টাব্দে পর্যন্ত তাঁকে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার অযোগ্য হিসাবে ঘোষণা দেওয়া।
১৯৪৯ খ্রিষ্টাব্দের শুরুর দিকে তিনি আসামে যান। এই সময় আসাম সরকার তাঁকে গ্রেফতার করে ধুবরি জেলে প্রেরণ করে। অল্প কিছুদিন পর মুক্তি পেয়ে তিনি ঢাকায় আসেন।
১৯৪৯ খ্রিষ্টাব্দের ২৩ জুন ঢাকার টিকাটুলীর কেএম দাস লেন রোডের রোজ গার্ডেন প্যালেসে— হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও আবুল হাশেমের নেতৃত্বাধীন তৎকালীন বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের একাংশের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন আতাউর রহমান খান। উক্ত সম্মেলনে উপস্থিত সদস্যদের সম্মতিতে 'পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ' নামক একটি রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠিত হয়। আর পুরো পাকিস্তানের জন্য দলটির নাম রাখা হয়— 'নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ'। সভায় সভাপতিত্ব করেন আতাউর রহমান খান। মওলানা ভাসানী ছিলেন প্রধান অতিথি।এই দলের পূর্ব পাকিস্তান শাখার সভাপতি হন- আব্দুল হামিদ খান ভাসানী এবং সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন শামসুল হক।
১৯৪৯ খ্রিষ্টাব্দের ২৪ জুন, আরমানীটোলা ময়দানে আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রথম জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৪৯ সালের মধ্যভাগে পূর্ববঙ্গে খাদ্যাভাব দেখা দেয়। ফলে ১১ অক্টোবর আরমানীটোলা ময়দানে আওয়ামী মুসলিম লীগের একটি জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। ওই সভায় খাদ্য সমস্যা সমাধানে ব্যর্থতার জন্য পূর্ববঙ্গ মন্ত্রিসভার পদত্যাগ দাবী করা হয় এবং ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে মওলানা ভাসানী ভুখা মিছিলে নেতৃত্ব দেন। এই মিছিলে নেতৃত্ব দেয়ার জন্য ১৯৪৯ খ্রিষ্টাব্দের ১৪ অক্টোবর তাঁকে গ্রেফতার করে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানো হয়।
১৯৫০ খ্রিষ্টাব্দে সরকার কর্তৃক রাজশাহী কারাগারের খাপরা ওয়ার্ড এর বন্দীদের উপর গুলিবর্ষণের প্রতিবাদে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে অনশন ধর্মঘট পালন করেন এবং ১৯৫০ খ্রিষ্টাব্দের ১০ ডিসেম্বর তিনি কারাগার থেকে মুক্তি পান।
১৯৫৩ খ্রিষ্টাব্দের ২১ ফেব্রুয়ারি শোভাযাত্রায় মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান
১৯৫৩ সালের ৪ঠা ডিসেম্বর, পূর্ববঙ্গের প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনকে সামনে রেখে― পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী মুসলিম লীগের সভাপতি মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, কৃষক-শ্রমিক পার্টির সভাপতি শের-এ-বাংলা এ. কে. ফজলুল হক এবং হোসেন শহীদ সোহ্রাওয়ার্দী মিলে একটি মোর্চা গঠন করে। ১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য এই মোর্চার নাম দেওয়া হয়েছিল 'যুক্তফ্রন্ট'। এই মোর্চা গঠনে প্রধান উদ্যোক্তা ছিল তৎকালীন 'আওয়ামী মুসলিম লীগ'। এই নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট পূর্ব বাংলার প্রাদেশিক পরিষদে ২৩৭টির মধ্য ২২৮টি আসন অর্জন করে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। এই সময় ফজলুল হকের নেতৃত্বে সরকার গঠন করা হয়।
১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দের মে দিবসে তিনি ঢাকা ও নারায়াণগঞ্জে দুটি বৃহৎ শ্রমিক সমাবেশ করেন। এই বৎসরেই তিনি পূর্ব-পাকিস্তানের কৃষক সমিতির সভাপতি হন। এরপর তিনি সমাজতান্ত্রিক আদর্শে সৃষ্ট আন্তর্জাতিক শান্তি কমিটির পূর্ব-পাকিস্তান শাখার সভাপতি পদে আসীন হন। ১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দে পর ২৫ মে, তিনি এই সমিতির পক্ষে বিশ্ব শান্তি সম্মেলনে যোগদানের উদ্দেশ্যে সুইডেনের রাজধানী স্টকহোমে যান। ৩০ মে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা ভেঙ্গে দেয় এবং পূর্ব পাকিস্তানে গভর্ণরের শাসন জারি করে। এই সময় মাওলানা ভাসানীর দেশে প্রত্যাবর্তনের উপর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়। ১১ মাস লন্ডন, বার্লিন, দিল্লী ও কলকাতায় অবস্থান করার পর, তার উপর থেকে আরোপিত নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া হয়। ১৯৫৫ খ্রিষ্টাব্দের ২৫ এপ্রিল দেশে তিনি দেশে ফিরে আসেন।
১৯৫৫ খ্রিষ্টাব্দের ২১-২৩ অক্টোবরে ঢাকায় অনুষ্ঠিত দলের তৃতীয় কাউন্সিল অধিবেশনে ধর্মনিরপেক্ষ চর্চা এবং অসাম্প্রদায়িক চেতনা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এই সংগঠনটির নাম থেকে 'মুসলিম' শব্দটি বাদ দেওয়া হয়। ফলে দলটির নতুন নাম হয়― আওয়ামী লীগ গঠিত হয়।
১৯৫৬ খ্রিষ্টাব্দের ৭ মে, পূর্ব বাংলায় খাদ্যজনিত দুর্ভিক্ষ রোধের জন্য― কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে ৫০ কোটি টাকা আদায়ের দাবিতে ঢাকায় অনশন ধর্মঘট শুরু করেন। সরকার দাবি মেনে নিলে ২৪ মে অনশন ভঙ্গ করেন। ১২ সেপ্টেম্বর হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ-রিপাবলিকান পার্টির কোয়ালিশন সরকার গঠিত হলে মাওলানা ভাসানী সরকারের পররাষ্ট্রনীতির বিরোধিতা করে নিরপেক্ষ নীতি অবলম্বন করার জন্য সরকারের উপর চাপ প্রয়োগ করেন। ১৯৫৬ খ্রিষ্টাব্দে পাকিস্তান গণপরিষদে যে খসড়া শাসনতন্ত্র বিল পেশ করা হয়, তাতে পাকিস্তানকে ইসলামিক রিপাবলিক বলে ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল। সে সময় তিনি এর বিরোধিতা করেন।
১৯৫৭ খ্রিষ্টাব্দে ৮-১০ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হয় কাগমারী সম্মেলন হয়। ৮ ফেব্রুয়ারি ডক্টর কাজী মোতাহার হোসেনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানটি আরম্ভ হয়। এই সভায় মওলানা ভাসানী তাঁর বক্তৃতায় বলেন― পূর্ববাংলা পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় শাসকদের দ্বারা শোষিত হতে থাকলে পূর্ববঙ্গবাসী তাদের সালামু ওআলায়কুম জানাতে বাধ্য হবে। এছাড়া কাগমারী সম্মেলনে ভাসানী পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তি বাতিলের দাবি জানান। প্রধানমন্ত্রী সোহ্রাওয়ার্দী সেই দাবি প্রত্যাখান করলে, ১৮ মার্চ আওয়ামী লীগ থেকে তিনি পদত্যাগ করেন। এই বছর ২৫ জুলাই তার নেতৃত্বে ঢাকার রূপমহল সিনেমা হলে 'ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি' (ন্যাপ) গঠিত হয়।
১৯৫৭ খ্রিষ্টাব্দের ৭ অক্টোবর দেশে সামরিক শাসন জারি হলে আইয়ুব খান ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন এবং সকল রাজনৈতিক দলের কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। ১২ অক্টোবর মাওলানা ভাসানীকে কুমুদিনী হাসপাতাল থেকে গ্রেফতার করা হয়। পরে তাঁকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে স্থানান্তরিত করা হয়।
১৯৬২ খ্রিষ্টাব্দের ২৬ অক্টোবর থেকে ২ নভেম্বর পর্যন্ত, জেলে থাকাকালীন সময়ে তিনি বন্যাদুর্গতদের সাহায্য ও পাটের ন্যায্যমূল্যসহ বিভিন্ন দাবিতে অনশন ধর্মঘট পালন করেন। ৩ নভেম্বর তিনি মুক্তিলাভ করেন। এরপর তিনি ন্যাশনাল ডেমোক্রাটিক ফ্রন্ট-এর রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার সাথে জড়িত হন।
১৯৬৩ খ্রিষ্টাব্দের মার্চ মাসে আইয়ুব খানের সাথে সাক্ষাৎ করেন। এই বছরের ২৪ সেপ্টেম্বর চীনের বিপ্লব দিবস-এর উৎসবে যোগদানের জন্য ঢাকা ত্যাগ করেন এবং চীনে সাত সপ্তাহ অবস্থান করেন।
১৯৬৪ খ্রিষ্টাব্দের ২৯ ফেব্রুয়ারি, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি পুনরুজ্জীবিত করে দলের সভাপতির দায়িত্বভার গ্রহণ করেন এবং এই বছরের ২১ জুলাই-তে সম্মিলিত বিরোধী দল (কপ) গঠনে ভূমিকা পালন করেন। এই বৎসরে তিনি হাভানায় বিশ্ব শান্তি সম্মেলনে যোগদান করেন।
১৯৬৫ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ জুলাই, আইয়ুব খানের পররাষ্ট্র নীতির প্রতি তিনি সমর্থন জ্ঞাপন করেন।
১৯৬৬ খ্রিষ্টাব্দের ৫ ও ৬ই ফেব্রুয়ারি লাহোরে অনুষ্ঠিত বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর এক সম্মেলনে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে শেখ মুজিবর রহমান পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ছয় দফা দাবি পেশ করেন। ভাসানী ছয় দফা কর্মসূচীর তিনি বিরোধিতা করেন।
১৯৬৭ খ্রিষ্টাব্দের ২২ জুন কেন্দ্রীয় সরকার রেডিও এবং টেলিভিশন থেকে থেকে রবীন্দ্র সঙ্গীত প্রচার বন্ধ করার নির্দেশ জারি করলে, তিনি এর তীব্র প্রতিবাদ করেন।
১৯৬৭ খ্রিষ্টাব্দের নভেম্বর মাসে ন্যাপ দ্বি-খণ্ডিত হলে তিনি চীনপন্থী ন্যাপের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন।
১৯৬৯ খ্রিষ্টাব্দে আইয়ুব বিরোধী আন্দোলনে তিনি বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেন। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামীদের মুক্তি দাবি করেন। ৮ মার্চ পশ্চিম পাকিস্তানে যান এবং পাকিস্তান পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টোর সাথে সাক্ষাৎ করেন। এই সময় উভয় নেতা গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র কায়েমের লক্ষ্যে একমত হন। ২৬শে ফেব্রুয়ারি আইয়ুব খান কর্তৃক আহুত গোলটেবিল বৈঠক প্রত্যাখান করে শ্রমজীবীদের ঘেরাও কর্মসূচী পালনে উৎসাহ প্রদান করেন। আইয়ুব খান সরকারের পতনের পর নির্বাচনের পূর্বে ভোটের আগে ভাত চাই, ইসলামিক সমাজতন্ত্র কায়েম ইত্যাদি দাবি উত্থাপন করেন।
১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দের ৬-৮ আগষ্ট বন্যা সমস্যা সমাধানের দাবিতে অনশন পালন করেন। এরপর তিনি সাধারণ নির্বাচনে অংশ গ্রহণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। ১২ নভেম্বর পূর্ব পাকিস্তানে প্রলয়ঙ্কারী ঘুর্ণিঝড় হলে দুর্গত এলাকায় ত্রাণ ব্যবস্থায় অংশ নেয়ার জন্য ন্যাপ প্রার্থীরা নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ান। ৪ ডিসেম্বর ঢাকার পল্টন ময়দানে এক জনসভায় 'স্বাধীন জনগণতান্ত্রিক পূর্ব-বাংলার' দাবি উত্থাপন করেন এবং পাকিস্তানের সাথে সকল সম্পর্ক ছিন্ন করার আহ্বান জানান।
১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের মার্চ মাসে শেখ মুজিবর রহমান অসহযোগ আন্দোলনের প্রতি সমর্থন প্রদান করেন। ১৮ জানুয়ারি পল্টন ময়দানে অনুষ্ঠিত জনসভায় স্বাধীনতার ঘোষণা প্রদানের জন্য তার প্রতি আহবান জানিয়েছিলেন। ২৫ মার্চ রাতে মওলানা ভাসানী টাঙ্গাইলের সন্তোষে তাঁর নিজগৃহে অবস্থান করছিলেন। এখান থেকে তিনি টাঙ্গাইল ছেড়ে তাঁর পিতৃভূমি সিরাজগঞ্জে চলে যান। পরে পাকিস্তান বাহিনী তার সন্তোষের বাড়িটি পুড়িয়ে দেয়।
সিরাজগঞ্জ থেকে মওলানা ভাসানী মোজাফ্ফর ন্যাপ নেতা সাইফুল ইসলামকে সঙ্গে নিয়ে নৌকাযোগে ভারত সীমানা অভিমুখে রওনা হন। অবশেষে ভারতের কেন্দ্রীয় মন্ত্রী মইনুল হক চৌধুরীর সাহায্যে মওলানা ভাসানী ও সাইফুল ইসলাম ১৫/১৬ এপ্রিল পূর্ব-পাকিস্তান অতিক্রম করে আসামের ফুলবাড়ী নামক স্থানে উপস্থিত হন এবং তাদের হলদীগঞ্জ বিএসএফ ক্যাম্পে আশ্রয় দেয়া হয়। এখান থেকে তিনি এবং সাইফুল ইসলাম বিমানযোগে কলকাতায় আসেন। এই সময় পার্ক স্ট্রিটের কোহিনুর প্যালেসের ৫তলার একটি ফ্ল্যাটে তাঁকে থাকার জন্য নির্ধারণ করা হয়। ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ২৩ এপ্রিল স্বাধীনতার পক্ষে প্রচারণা চালান। তিনি চীনের নেতা মাও সে তুং, চৌ এন লাই এবং যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের কাছে তার বার্তা পাঠিয়ে তাদের অবহিত করেন যে পূর্ববঙ্গে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ব্যাপকহারে গণহত্যা চালাচ্ছে। সেজন্য তিনি প্রেসিডেন্ট নিক্সনকে অনুরোধ করেন এই মর্মে যে, তিনি যেন পাকিস্তানকে অস্ত্র সরবরাহ না করেন। উপরন্তু মওলানা ভাসানী প্রেসিডেন্ট নিক্সনকে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবার আহ্বান জানান। ২৫ এপ্রিল মাওলানা ভাসানী সোভিয়েত রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট কাছে পাকিস্তান বাংলাদেশের জনগণের ওপর যে বর্বরোচিত অত্যাচার চালাচ্ছে তার বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য অনুরোধ করেন।
৩১ মে মাওলানা ভাসানী এক বিবৃতিতে বলেন, বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ দখলদার বাহিনীর সঙ্গে জীবনমরণ সংগ্রামে লিপ্ত। তারা মাতৃভূমি রক্ষার জন্য বদ্ধপরিকর। তারা এই সংগ্রামে জয়লাভ করবেই। ৭ জুন মওলানা ভাসানী এক বিবৃতিতে বলেন, বাংলাদেশের সব অঞ্চল আজ দশ লাখ বাঙালির রক্তে স্নাত এবং এই রক্তস্নানের মধ্য দিয়েই বাংলার স্বাধীনতা আসবে। এই সময় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ দু'বার কোহিনুর প্যালেসে এসে মওলানা ভাসানীর সঙ্গে বৈঠকে মিলিত হন এবং তার পরামর্শ ও সহযোগিতা প্রার্থনা করেন।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে সর্বদলীয় চরিত্র দেয়ার উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ সরকারের উদ্যোগে আট সদস্যবিশিষ্ট উপদেষ্টা কমিটি গঠিত হয় যার সভাপতি ছিলেন মওলানা ভাসানী। ওই উপদেষ্টা কমিটির সদস্য ছিলেন― তাজউদ্দীন আহমদ, মণি সিংহ, অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ, মনোরঞ্জন ধর প্রমুখ। মওলানা ভাসানীর সভাপতিত্বে ওই উপদেষ্টা কমিটির সভায় এই মর্মে অভিমত ব্যক্ত করা হয় যে, পূর্ববঙ্গের পূর্ণ স্বাধীনতা ব্যতিরেক অন্য কোন প্রকার রাজনৈতিক সমাধান গ্রহণযোগ্য হবে না।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে মওলানা ভাসানী কলকাতা ছাড়াও দেরাদুন, দিল্লী ও অন্যান্য স্থানে অবস্থান করেন। ভারতে অবস্থানকালে মওলানা ভাসানী দুইবার অসুস্থ হয়ে পড়েন। তখন তাকে দিল্লী অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অফ মেডিকেল সায়েন্সে ভর্তি করা হয়েছিল।
১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দের ২২ জানুয়ারি বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করেন। ২২ জানুয়ারিতে, বাংলাদেশ থেকে ভারতীয় সৈন্যের অপসারণের দাবি তোলেন। ২৫ ফেব্রুয়ারি সাপ্তাহিক হক-কথা প্রকাশ করেন। বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রীচুক্তির বিরোধিতা করলেও মুজিব সরকারের জাতীয়করণ নীতি এবং ১৯৭২-এর সংবিধানের এর প্রতি সমর্থন প্রকাশ করেন।
১৯৭৩ খ্রিষ্টাব্দে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, আইন-শৃঙ্খলার অবনিত এবং খাদ্যের দাবিতে ঢাকায় ১৫-২২ মে অনশন ধর্মঘট পালন করেন।
১৯৭৪ খ্রিষ্টাব্দের ৮ এপ্রিল, 'হুকুমতে রাব্বানিয়া সমিতি' গঠন করেন। এপ্রিল মাসে তিনি ৬টি দল নিয়ে যুক্তফ্রন্ট তৈরি করেন। ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত চুক্তি রদকরণ এবং বিরোধীদলের উপর নিপীড়ন বন্ধ করার জন্য আন্দোলন শুরু করলে, জুন মাসে টাঙ্গাইলের সন্তোষে গৃহবন্দি হন।
১৯৭৬ খ্রিষ্টাব্দে ১৬ মে, ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণের প্রতিবাদে ঐতিহাসিক লং মার্চে নেতৃত্ব দেন। এই বছর ২ অক্টোবর, খোদাই খিদমতগার নামে নতুন আর একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন।
১৯৭৬ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ই নভেম্বর, ৯৬ বৎসর বয়সে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তিনিা মৃত্যুবরণ করেন। তাঁকে টাঙ্গাইলের সন্তোষে দাফন করা হয়।
আসামে ৩০ টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি কারিগরী শিক্ষা কলেজ, শিশু কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেন সন্তোষে। এছাড়াও তিনি কাগমারিতে মাওলানা মোহাম্মদ আলী কলেজ এবং পঞ্চবিবিতে নজরুল ইসলাম কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন।
প্রকাশিত গ্রন্থ
দেশের সমস্যা ও সমাধান (১৯৬২)
মাও সে তুং-এর দেশে (১৯৬৩)
তথ্যসূত্র :
শিশু-বিশ্বকোষ (চতুর্থ খণ্ড)। বাংলাদেশ শিশু একাডেমী। আশ্বিন ১৪০৪, সেপ্টেম্বর ১৯৯৭।