আজ মুসলিম জাতির অধঃপতনের মুল কারণ অনৈক্য !

আজ মুসলিম জাতির অধঃপতনের মুল কারণ অনৈক্য

আজ মুসলিম জাতির অধঃপতনের মুল কারণ অনৈক্য


ঐক্যের ব্যাপারে কোরআনে পাকে বার বার আমাদের তালিম দেওয়া শর্তেও আমরা ঐক্যের প্রতি দৃষ্টি দেওয়া তো দূরে থাক এর নামই শুনতে পারি না । কোরআনে আমাদেরকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার ঘোষনা দিয়েছিন । এ সর্ম্পকে মহান রাব্বুল আলামিন ইরশাদ করেন, ‘হে মুমিনগণ! তোমারা আল্লাহর রজ্জুকে (ইসলাম) আঁকড়ে ধর (ঐক্যবদ্ধ হও) এবং পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না। ’ -সূরা আল ইমরান: ১০৩। 


এছাড়াও কোরআনের অন্যত্র আয়াতে উল্লেখ আছে  ‘তোমরা  সেসব লোকদের মতো হয়ো না, যাদের কাছে স্পষ্ট ও প্রকাশ্য নিদর্শন আসার পরও তারা বিভিন্ন দল-উপদলে বিভক্ত হয়ে পড়েছে এবং নানা ধরনের মতানৈক্য সৃষ্টি করেছে, তাদের জন্য রয়েছে কঠোর শাস্তি। ’ -সূরা আল ইমরান: ১০৫


এর থেকে আমরা বুঝতে পারলাম একতা কতই না গুরুত্বপূর্ণ । আজ আমাদের দেশের মুসলিম সমাজেই যদি চোখ বুলান আপনি দেখবেন মুসলিমদের মধ্যে প্রায় ৭২ থেকে ১০০ মতবাদের জন্ম হয়েছে । কেউ আছে চাদঁ দেখে রোজা রাখে, কেউ আবার সৌদি আরবের সাথে মিল রেখে রোজা রাখে, কেউ মাইকের ব্যবহারকে শিরক মনে করে আবার কেউ শুধু কোরআন মানে, আবার কেউ শুধু হাদিস মানে, কেউ শুধু সুন্নাহ মানে, আবার কেউ সাহাবীদের আমল বা তাবেয়ীদের আমলকে অগ্রাহ্য করে , আবার কেউ সাহাবাদেরকে গালমন্দও করে মোটকথা এক এক জন্য এক এক হালতের । 


এই যে অনৈক্যতা বিরাজমান একটি ছোট্ট দেশের মধ্যে আমরা কোরআন একটাই পেয়েছি , আমাদের নবীজী হযরত মুহাম্মদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যথাযথ নির্দেশনা পেয়েছি সাহাবাগণ, তাবেয়ী, তবে তাবেয়ী, চার মাযহাবের ইমান এবং আল্লাহর অলিদের মাধ্যমে । যারা ইসলামকে পুরো পৃথিবীতে ভালবাসা দিয়ে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন । আপনি দেখুন খাজা গরীবে নেওয়াজ রহমাতুল্লাহি আলাইহি যিনি ইন্তেকালের সময় উনার জানাজায় শরীক হয় প্রায় ৯০ লক্ষ মুসলমান । উনারা ইসলামটাকে কিভাবে সাজিয়েছে ? আমরা কিভাবে সাজাচ্ছি ? উনাদের কাছে মুসলিমরাই শুধু ভালবাসা পেত তাই নয় , উনাদের কাছে অন্যান্য ধর্মের লোকেরাও ভালবাসা পেত যার কারণে পুরো ভারতবর্ষ জুড়ে হযরত মঈনউদ্দিন চিশতীর নাম ছড়িয়ে আছে । উনারদের জীবনী চিন্তা চেতনা গবেষনা করে এটাই বুঝতে পারলাম । উনারা মুসলিমদের ঐক্যবদ্ধ রেখেছেন । উনারা পুরো মুসলিম জাতিকে জোড়া লাগিয়েছেন ছিন্ন বিছিন্ন জাতিকেও উনারা একই প্লাটফর্মে এনেছেন । যারা কারণে উনাদের প্রতি মানুষের এতো ভালবাসা এতো মুহাব্বত ।


ইসলামের শান্তির এই বানী পুরো পৃথিবী ছড়িয়ে দিতে মুসলামদের একে অন্যের প্রতি ভালবাসা বৃদ্ধির বিকল্প নেই । পবিত্র কোরআন ও হাদিসে ঈমানের পর ঈমানদারদের ঐক্যবদ্ধ থাকার জন্য সবচেয়ে জোরালো তাগিদ দেওয়া হয়েছে।


ইসলামী ভ্রাতৃত্বের মানদন্ড ঈমান। তাই একজন মুমিন অপর মুমিনের প্রতি সম্প্রীতি-ভালবাসা, সহানুভূতি ও সহযোগিতার হাত সম্প্রসারিত করবে, তা সে যে দেশের হোক, যে বর্ণের কিংবা যে ভাষারই হয়ে থাকুন। কুরআনে হাকিমে ইরশাদ হয়েছে-


اِنَّمَا الْمُؤْمِنُوْنَ اِخْوَةٌ فَاَصْلِحُوْا بَیْنَ اَخَوَیْكُمْ.

মুমিনগণ পরস্পর ভাই ভাই। সুতরাং, তোমরা তোমাদের দুই ভাইয়ের মাঝে মীমাংসা করে দাও। -সূরা হুজুরাত (৪৯) : ১০

আরেক আয়াতে ইরশাদ হয়েছে-

وَ الْمُؤْمِنُوْنَ وَ الْمُؤْمِنٰتُ بَعْضُهُمْ اَوْلِیَآءُ بَعْضٍ.

মুমিন নর ও মুমিন নারী সকলেই একে অন্যের বন্ধু। -সূরা তাওবা (৯) : ৭১

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-

مَثَلُ الْمُؤْمِنِينَ فِي تَوَادِّهِمْ، وَتَرَاحُمِهِمْ، وَتَعَاطُفِهِمْ مَثَلُ الْجَسَدِ إِذَا اشْتَكَى مِنْهُ عُضْوٌ تَدَاعَى لَهُ سَائِرُ الْجَسَدِ بِالسّهَرِ وَالْحُمّى.

সম্প্রীতি, সৌহার্দ্য ও সহানুভূতির ক্ষেত্রে মুমিনদের দৃষ্টান্ত এক দেহের ন্যায়, যার একটি অঙ্গ অসুস্থ হলে গোটা দেহ জ¦র ও অনিদ্রায় আক্রান্ত হয়। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৬০১১; সহীহ মুসলিম, হদীস ২৫৮৬

অন্য হাদীসে ইরশাদ হয়েছে-

الْمُؤْمِنُ مِرْآةُ الْمُؤْمِنِ، وَالْمُؤْمِنُ أَخُو الْمُؤْمِنِ، يَكُفّ عَلَيْهِ ضَيْعَتَهُ، وَيَحُوطُهُ مِنْ وَرَائِهِ.

মুমিন মুমিনের জন্য আয়না। মুমিন মুমিনের ভাই। সে তার জমি সংরক্ষণ করে এবং তার অনুপস্থিতিতে তাকে হেফাযত করে। -সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৪৯১৮

এই সম্প্রীতি ও সহযোগিতার নির্দেশ তাকওয়া ও কল্যাণের পথে, ন্যায় ও বৈধ কাজে। কুরআনে কারীমের ইরশাদ-

وَ تَعَاوَنُوْا عَلَی الْبِرِّ وَ التَّقْوٰی وَ لَا تَعَاوَنُوْا عَلَی الْاِثْمِ وَ الْعُدْوَان.

তোমরা তাকওয়া ও ন্যায় কাজে পরস্পরে সহযোগিতা করো। পাপাচার ও অন্যায় কাজে সহযোগিতা করো না। -সূরা মায়েদা (৬) : ০২


মক্কা থেকে মদীনায় হিজরতের পর নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুহাজির ও আনসার ছাহাবীদের মাঝে আনুষ্ঠানিকভাবে ভ্রাতৃত্ব স্থাপন করে দিয়েছিলেন। সুন্দর শৃংখলার জন্য মুহাজির ও আনসারের কে কার সাথে বসবাস করবেন সেটাও নির্দিষ্ট করে দিয়েছিলেন। আবদুর রহমান বিন আউফের ভ্রাতৃত্ব স্থাপন করেছিলেন আনসারী সাহাবী সা‘দ বিন রবীর সাথে। তিনি আবদুর রহমান বিন আউফকে ঘরে নিয়ে গেলেন। এরপর তাকে সম্বোধন করে বললেন, ভাই আবদুর রহমান! আজ থেকে আমার অর্ধেক সম্পদের মালিক তুমি। আর শোনো, আমার দু'জন স্ত্রী রয়েছে। তোমার যাকে পছন্দ হয় বল, আমি তাকে তালাক দিয়ে দিব। ইদ্দত শেষ হলে তুমি তার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হবে। 

আবদুর রহমান বিন আউফ রা. জবাবে বললেন, ভাই সা‘দ! আল্লাহ পাক তোমার সম্পদ ও পরিবারে বরকত দান করুন। তোমার সবকিছু তোমার কাছেই থাক। আমাকে শুধু বাজারের রাস্তাটা দেখিয়ে দাও। আমি ব্যবসা করতে চাই। সা‘দ বিন রবী রা. তাকে বনু কায়নুকার বাজার দেখিয়ে দিলেন। তিনি সেখানে গিয়ে বেচা-কেনা শুরু করলেন। প্রথম দিনই কিছু টাকা লাভ হল। তা দিয়ে তিনি খাওয়ার জন্য কিছু ঘি ও মাখন কিনে আনলেন। এভাবে তার ব্যবসায় দিন দিন উন্নতি হতে লাগল। নিজ হাতের উপার্জনের মাধ্যমেই তিনি আস্তে আস্তে সচ্ছল হয়ে উঠলেন। এরপর এক আনসারী নারীর সাথে তার বিবাহ হল। (সহীহ বুখারী, হাদীস ৫১৬৭; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১৩৮৬৩; মুসনাদে আবদ ইবনে হুমাইদ, হাদীস ১৩৩৩)


সাহাবায়েকেরাম একে অন্যের প্রতি এত বেশি মুহাব্বত এবং তারা এতটা ঐক্যবদ্ধ ছিল যে তারা যুদ্ধের সময়ও কঠিন মুহুর্তেও তাদের ভাতৃত্ববোধের কমতি ছিল না । এর একটাই কারণ তাদের মধ্যে ঐক্যতা ছিল একজনের প্রতি অন্যজনের ভালবাসায় পরিপূর্ণ ছিল । দুনিয়ার মোহ তাদের মধ্যে ছিল না । তারা কোরআনের বানীগুলো যথাযথভাবে আয়ত্ব করেছে ।

তাই অনৈক্যের বিষয়ে সতর্ক করে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা বলেন, তোমাদের এ সব জাতিগুলো একই জাতি, আর আমি তোমাদের প্রতিপালক, কাজেই আমারই ‘ইবাদাত কর। কিন্তু তারা নিজদের কার্যকলাপে পরস্পরের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করেছে। সকলেই আমার নিকট প্রত্যাবর্তন করবে।  (সুরা-২১ আম্বিয়া, আয়াত: ৯২-৯৩) 


তোমাদের এই দীন তো একই দীন। আর আমি তোমাদের রব, অতএব তোমরা আমাকে ভয় কর।তারপর লোকেরা তাদের মাঝে তাদের দীনকে বহুভাগে বিভক্ত করেছে। প্রত্যেক দলই তাদের কাছে যা আছে তা নিয়ে উৎফুল্ল। (সুরা-২৩ মুমিনূন, আয়াত: ৫২-৫৩) ‘আল্লাহর কাছে উম্মত একটিই।’ (সুরা-১০ ইউনুস, আয়াত: ১৯)



ইসলামে কোটি টাকার মালিকের মযার্দা নাই , আল্লাহর কাছে সবচেয়ে মযার্দাবান ব্যক্তি হল ইমানদার এবং তাকওয়াবান ব্যক্তি । এককথায়  ইমান ও ইসলামের সঙ্গে মর্যাদার মাপকাঠি হলো তাকওয়া ও ইখলাস। ঐক্যের জন্য চাই ত্যাগের মানসিকতা, সহনশীলতা, সদাচার ও উদারতা। যার সূত্র হিসেবে রাসুলুল্লাহ (সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ) বলেন, ‘তোমরা মন্দ ধারণা থেকে বেঁচে থাকো।


কারণ, মন্দ ধারণা হচ্ছে নিকৃষ্টতম মিথ্যাচার। এই বিষয়ে কোরআনে পাকে এরশাদ হয়েছে - ‘আর যে বিষয় তোমার জানা নাই তার অনুসরণ করো না। নিশ্চয় কান, চোখ ও অন্তকরণ- এদের প্রতিটির ব্যাপারে সে জিজ্ঞাসিত হবে।’ (সুরা বনি ইসরাইল : আয়াত ৩৬)

কোরআনের অনত্র এরশাদ করেন - ‘তোমরা বিবিধ ধারনা করা থেকে বেঁচে থাক; কেননা কোন কোন ধারনা করা গুনাহের পর্যায়ে পড়ে।’ (সুরা আল-হুজুরাত : আয়াত ১২)

বুখারী শরীফে হযরত আবূ হুরাইরাহ (রাদিয়াল্লাহ আনহু) বলেন যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতে বর্ণিত। তোমরা কারো প্রতি খারাপ ধারণা পোষণ করো না। কেননা, খারাপ ধারণা সবচেয়ে বড় মিথ্যা। একে অপরের দোষ-ত্রুটি খুঁজিও না, একে অন্যের ব্যাপারে মন্দ কথায় কান দিও না এবং একে অপরের প্রতি শত্রুতা পোষণ করো না; বরং ভাই ভাই হয়ে যাও। [৬০৬৪, ৬০৬৬, ৬৭২৪] (আধুনিক প্রকাশনী- ৪৭৬৪, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৪৭৬৭)


এই মুসলিম উম্মাহ আজ নিপীড়িত, অসহায়, অত্যাচার এবং অনাচারের সাক্ষী হয়ে আছে কারণ আজ আমরা এক নয় । ইহুদী-খ্রিস্টান সম্প্রদায় আমাদেরকে একে অন্যের সাথে হিংসা এবং বিদ্বেষে লেলিয়ে দিয়েছে । আমাদের এমনভাবে তারা গ্রাস করেছে আমরা এখন এক মুসলিম ভাই অন্য মুসলিম ভাইকে কাফের ফতোয়া দিচ্ছি । আমরা এক মুসলিম দেশ অন্য মুসলিম দেশের সাথে যুদ্ধ করছি যার মধ্যস্থতা করছে যুক্তরাস্ট্র, ব্রিটেনসহ যারা মুসলিম বিদ্বেষী । আজ থেকে কয়েকশত বছর আগে যারা আমাদের কর দিত তারা এখন আমাদের মাথার উপর চড়াও হয়ে উঠেছে । যারা আমাদের নাম শুনলে চিন্তার ভাজ পড়ে যেত তারা এখন আমাদের উপর পারমানবিক বোমার তাক করে । এর একটাই কারণ আজ আমরা ইমানে পরিপূর্ণ নয় , আমরা নামে মুসলমান । আমাদের অন্তরে ইমানের আলো নেই । আমরা সুদ ঘুষ, জুলুমি, দুনিয়ার লোভে মত্ব আবার মসজিদের প্রথম কাতারে নামাজেও যায়, কিন্তু অন্তরে ইসলাম ধারণ করি না । আজ মুসলিম দেশে রমজানে দ্রব্যমূল্যের উর্দ্ধগতি দেখা যায় , কিন্তু অমুসলিম দেশে আমরা তার বিপরীত দেখি । জাতি হিসেবে আমরা কতটুকু নিচে নেমেছি । আমাদের আদর্শ কোথায়? আল্লাহ পুরো মুসলিম বিশ্বকে ঐকবদ্ধ হওয়ার তৌফিক দান করুন । আসুন আমরা মুসলিমরা এক হই , ভেদাভেদ ভুলে এককাতারে আসি । এটাই কোরআনের বানী । 


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Be alert before spamming comments.

নবীনতর পূর্বতন

Sponsored

Responsive Ad