লাইলাতুল মেরাজ : মি’রাজের রাত্রে নাবী (দরুদ) কি আল্লাহকে দেখেছেন?

লাইলাতুল মেরাজ :  মি’রাজের রাত্রে নাবী (দরুদ) কি আল্লাহকে দেখেছেন?


লাইলাতুল মেরাজ :  মি’রাজের রাত্রে নাবী (দরুদ) কি আল্লাহকে দেখেছেন?

নবীজী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহকে সরাসরি দেখেছেন কি না?

সরাসরি দেখা বিষয়ে সাহাবায়ে কেরামগণ ও উলামাগণের মাঝে মতভেদ আছে।

১ . হযরত আয়শা রাঃ, হযরত আবু হুরায়রা রাঃ, হযরত ইবনে মাসঊদ রাঃ এবং ইমাম আহমাদ রহঃ এর এক মত অনুসারে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহ তাআলাকে সরাসরি দেখেননি।

২. হযরত ইবনে আব্বাস রাঃ, হযরত আনাস রাঃ, হযরত ইকরিমা রহঃ, হযরত হাসান রহঃ, হযরত রাবী বিন সুলাইমান রহঃ, হযরত ইবনে খুযাইমা রহঃ, হযরত কা’বে আহবার রহঃ, হযরত যুহরী রহঃ, হযরত উরওয়া বিন যুবায়ের রহঃ, হযরত মা’মার রহঃ, হযরত আশআরী রহঃ এবং ইমাম আহমাদ রহঃ এর বক্তব্য অনুপাতে সরাসরি আল্লাহকে দেখেছেন।এমতটিই ইমাম নববী রহঃ প্রাধান্য দিয়েছেন। [শরহে মুসলিম, ইমাম নববীকৃত, কিতাবুল ঈমান, বাবু মা’না কওলিল্লাহ ওয়ালাক্বাদ রাআহু-৩/৬-৭, বর্ণনা নং-২৮০ (১৭৪)]

আমাদের তাহকীক মতে আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মেরাজের রাতে আল্লাহকে দেখেছেন। অন্তর দিয়ে অনুভবে যেমন দেখেছেন, তেমনি চর্মচক্ষেও দেখেছেন ।

عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ، قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: ” رَأَيْتُ رَبِّي تَبَارَكَ وَتَعَالَى

হযরত ইবনে আব্বাস রাঃ থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, আমি আমার রব আল্লাহকে দেখেছি। [মুসনাদে আহমাদ, হাদীস নং-২৫৮০, সুনানে কুরবা নাসায়ী, হাদীস নং-১১৪৭৩,মু’জামে ইবনুল আরাবী, হাদীস নং-১৬৮৫,]
হাদীসটি সহীহ।

أَنَّ عَبْدَ اللَّهِ بْنَ عَبَّاسٍ، كَانَ يَقُولُ: «إِنَّ مُحَمَّدًا صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، رَأَى رَبَّهُ مَرَّتَيْنِ: مُرَّةً بِبَصَرِهِ، وَمَرَّةً بِفُؤَادِهِ»


হযরত ইবনে আব্বাস রাঃ থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহকে দুইবার দেখেছেন, একবার স্বচক্ষে, আরেকবার অন্তর দ্বারা অনুভব করে। [আলমু’জামুল আওসাত, তাবরানীকৃত, হাদীস নং-৫৭৬১]

একটি প্রশ্ন ও উত্তর


قَالَ رَجُلٌ: أَلَيْسَ اللَّهُ عَزَّ وَجَلَّ يَقُولُ: {لَا تُدْرِكُهُ الْأَبْصَارُ} [الأنعام: 103] ؟ فَقَالَ عِكْرِمَةُ: أَلَيْسَ تَرَى السَّمَاءَ؟ قَالَ: بَلَى، قَالَ: فَكُلَّهَا تَرَى؟


এক ব্যক্তি জিজ্ঞাসা করল, আল্লাহ কি বলেননি যে, “দৃষ্টিসমূহ তাকে পেতে পারে না [আনআম-১০৩] (তাহলে নবীজী কিভাবে আল্লাহকে দেখলেন?) প্রশ্নের জবাবে ইকরিমা রহঃ বললেন, তুমি কি আসমানে [আসমানের উপরের জান্নাতে প্রবেশ করে] আল্লাহকে দেখবে না? লোকটি বলল, অবশ্যই। তিনি বললেন, এটাতো এমনি। [আল্লাহর নবীতো জমিনে আল্লাহকে দেখেননি, বরং সাত আসমান টপকে গিয়ে আল্লাহকে দেখেছেন। তাই এ আয়াতের বিরোধীতা হচ্ছে কিভাবে?] {রু’য়াতুল্লাহ, ইমাম দারাকুতনীকৃত, হাদীস নং-২৭৮, আসসুন্নাহ, ইবনে আবী আসেমকৃত, হাদীস নং-৪৩৪}

আল্লাহর একান্ত সান্বিধ্যে

আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তা’য়ালা সূরা নজমের ৭ ও ৮ নং আয়াতে এরশাদ ফরমান-

ثم دنى فتدلى فكان قاب قوسين او ادنى 

অর্থাৎ: অতঃপর তিনি নিকটবর্তী হলেন, আরো নিকটবর্তী হলেন, অতঃপর দুই ধনুকের দুরুত্ব পরিমাণ ব্যবধান রইল এর চেয়েও আরো কম। (উজুব ও ইমকানের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ অক্ষুন্ন রেখে আল্লাহর বন্দেগির মাধ্যমে উলুহিয়ত তথা আল্লাহর দরবারে উবুদিয়তের সর্বোচ্চ মর্যাদায় অধিষ্টিত হলেন)। এ প্রসঙ্গে আল্লামা মুহাক্বিক শেখ আব্দুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভী আলাইহির রহমত مدارج النبوة ‘মাদারিজুন নবুয়ত’ নামক কিতাবের প্রথম জিলদের ২০৪ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেছেন-

وبایدد انست کہ این ثم دنى فتدلى کہ مذکور شداست ومعبر بقاب قوسین او ادنی گشت ومذکوراست دراحادیث معراج غیر ثم دنی فتدلی کہ مذکوراست در سورۂ والنجم کہ ان نسبت برویت و قرب جبرئیل است بقول مختار وسباق وسیاق آیۃ نیز ظاھر است دران وبعضے برویت وقرب پرور دگار تعالی وتقدس نیز حمل کردہ اند چنانکہ در کتب تفسیر مذکورست الخ 

ভাবার্থ: ‘জেনে রাখা প্রয়োজন মি’রাজ সংক্রান্ত আয়াতে কারিমা ثم دنى فتدلى ‘সুম্মা দানা ফাতাদাল্লা’ অতঃপর সেই জ্যোতি নিকটবর্তী হয়, তারপর আরো সন্নিকটে নেমে আসে, এর ব্যাখ্যা قاب قوسين যখন সেই জ্যোতি আর প্রেমাস্পদের মাঝখানে মাত্র দুই ধনুকের ব্যবধান থেকে যায় বরং এর চেয়েও কম। এ আয়াতে কারিমা মি’রাজের হাদিসসমূহে বর্ণিত হয়েছে এবং ইহা সূরা-ই আন নজমে যা উল্লেখ করা হয়েছে। কেননা بقول مختار গ্রহণযোগ্য মতানুযায়ী উহার সম্বন্ধ হযরত জিব্রাইল আলাইহিস সালাম এর দিদার ও তাঁর সাথে নৈকট্যতার প্রতি করা হয়েছে। আর পবিত্র আয়াতে কারিমার পূর্বাপর বাহ্যিক গতিধারাও ইহাই। কোন কোন মুফাসসির আল্লাহতা’য়ালার দিদার এবং তাঁর সাথে নৈকট্যলাভের অর্থও করেছেন, যেমন তাফসিরের কিতাবসমূহে বর্ণনা করা হয়েছে।’ মুহাক্বিক শেখ আব্দুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভী আলাইহির রহমতের উপরোক্ত আলোচনার দ্বারা আয়াতে কারিমার অর্থ হবে- ১. গ্রহণযোগ্য মত بقول مختار অনুযায়ী জিব্রাঈল আলাইহিস সালামের মূল আকৃতির দিদার ও তাঁর সাথে নৈকট্যতার প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। ২. কোন কোন মুফাসসির আল্লাহ তা’য়ালার দিদারও তাঁর সাথে নৈকট্যলাভের অর্থ করেছেন। এমতাবস্থায় আয়াতে কারিমার ভাবার্থ হবে, আল্লাহতা’য়ালা হলেন স্রষ্টা এবং হাবিবে খোদা হলেন তাঁরই বেনজির বেমিসাল সৃষ্টি, যার তুলনা সৃষ্টিজগতে নেই। অপরদিকে আল্লাহতা’য়ালা হচ্ছেন অজুব এবং তাঁর হাবিব হচ্ছেন ইমকান। অজুব ও ইমকানের নিয়ন্ত্রণ অক্ষুন্ন রেখে উলুহিয়ত ও উবুদিয়তের যথাযথ মর্যাদায় হাবিবে খোদা সেখানে অধিষ্টিত হলেন। আর চর্মচক্ষু মোবারক দ্বারা আল্লাহর দিদারে ধন্য হলেন। অন্যথায় অজুব ও ইমকানের মধ্যে ইত্তেহাদ বা উভয়ে এক হয়ে যাওয়া কস্মিনকালেও সম্ভব নয়। কেননা আল্লাহতা’য়ালা কোন কিছুর সাথে একীভূত হওয়া অথবা কোন বস্তুর মধ্যে হুলুল বা অনুপ্রবেশ হওয়া থেকে পবিত্র। গাউসুল আ’জম শায়খ সৈয়দ আব্দুল কাদির জিলানী রাদিয়াল্লাহু আনহু এ অভিমত ব্যক্ত করেছেন। (তাফসিরে আল জিলানী) আল কামুসুল মুহিত গ্রন্থকার আল্লামা মাজদুদ্দিন মুহাম্মদ বিন ইয়াকুব ফিরুজাবাদী রহমতুল্লাহ আলাইহি সংকলিত

تنوير المقباس من تفسير ابن عباس 

‘তানভীরুল মিকবাস মিন তাফসিরে ইবনে আব্বাস’ নামক গ্রন্থে সূরা নজমের উপরোক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় রাইসুল মুফাসসিরীন হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু (ওফাত ৯৮ হিজরি) এর বর্ণনা উল্লেখ করে বলেন-

(فاستوى) جبريل فى صورته التى خلقه الله عليها ويقال فاستوى فى صورة خلق حسن (وهو بالافق الاعلى) بمطلع الشمس ويقال فى السماء والسابعة ( ثم دنى) جبريل الى محمد صلى الله عليه وسلم ويقال محمد الى ربه (فتدلى) فتقرب (فكان قاب قوسين) من قسى العرب (او ادنى) بل ادنى بنصف قوس- 

তরজমা: অতঃপর জিব্রাইল আমিন স্বীয় আসলি সুরতে প্রকাশ হলেন অথবা অর্থ এই যে, উত্তম আকৃতি ও অবয়বে প্রকাশ হলেন, এমতাবস্থায় যে, তিনি পূর্বদিগন্তে ছিলেন। অথবা অর্থ এই যে, সপ্ত আকাশের কিনারায় ছিলেন। অতঃপর জিব্রাইল আমিন রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকটবর্তী হলেন। কেউ কেউ বলেছেন- অর্থ এই যে, হুজুর আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পরওয়ার দিগারে আলমের নিকটবর্তী হলেন, যে নৈকট্যের কারণে দুই ধনুকের সমান দূরুত্ব অবশিষ্ট ছিল বরং অর্ধ্ব ধনুকের দূরুত্ব অবশিষ্ট ছিল।’ তানভীরুল মিকবাস মিন তাফসিরে ইবনে আব্বাস’ এ কিতাবের ভাষ্য অনুযায়ী স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হলো-

ثم دنى فتدلى فكان قاب قوسين او ادنى 

এ আয়াতে কারিমার ভাবার্থ হলো- জিব্রাইল আমিন হাবিবে খোদার নিকটবর্তী হয়েছেন। কেউ কেউ বলেছেন- হাবিবে খোদা আল্লাহর নিকটবর্তী হয়েছেন। প্রকাশ থাকে যে, আল্লাহর নিকটও নেই দূরও নেই। সুতরাং আল্লাহর হাবিব আল্লাহর নিকটে এসেছেন এর ভাবার্থ হলো- আল্লাহর হাবিব উবুদিয়তের মাধ্যমে আল্লাহর দরবারে সৃষ্টির মধ্যে অতুলনীয় মর্যাদায় অধিষ্টিত হয়ে আল্লাহর দিদারে ধন্য হয়েছেন। এছাড়া নবী বংশের অমূল্য রত্ন গাউসে রাব্বানী ইমামে ছামদানী সাইয়্যিদ মহিউদ্দিন আব্দুল কাদির জিলানী (ওফাতশরীফ ৭১৩ হিজরি) তদীয় تفسير الجيلانى ‘তাফসিরে আল জিলানী’ নামক কিতাবের পঞ্চম জিল্দ ৭৮ পৃষ্ঠায় ثم دنى فتدلى ‘সুম্মা দানা ফাতা দাল্লা’ এ আয়াতে কারিমার তাফসিরে উল্লেখ করেছেন-

(ثم دنى) وتقرب الى ربه (فتدلى) النجم) وتعلق به سبحانه نوع تعلق ولحوق الى حيث (فكان) قرب ما بينهما (قاب قوسين) اى مقدار قوسى الوجوب والامكان الحافظين لمرتبتى الالوهية والعبودية (او ادنى) النجم: واقرب منهما الفناء حصة الناسوت مطلقا فى حصة اللاهوت- 

লাইলাতুল মেরাজ : মিরাজ এবং ইসরা এর পার্থক্য কি?

ভাবার্থ: ‘অতঃপর তিনি নিকটবর্তী হলেন অর্থাৎ তিনি তাঁর রবের নৈকট্য অর্জন করলেন। অতঃপর আরো নিকটবর্তী হলেন। (সূরায়ে নজম আয়াত- ৮) আল্লাহ সুবহানাহু তা’য়ালার বিশেষ ধরনের সম্পর্কের সাথে সম্পর্কিত হলেন এবং যথাসাধ্য নিকটবর্তী হলেন। অর্থাৎ দুই ধনুকের দূরুত্ব বরাবর নিকটবর্তী হলেন। দুই ধনুকের দূরুত্ব পরিমাণ তথা অজুব ও ইমকানের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ অক্ষুন্ন রেখে আল্লাহর বন্দেগির মাধ্যমে উলুহিয়ত বা আল্লাহর দরবারে উবুদিয়তের সর্বোচ্চ মর্যাদায় অধিষ্টিত হলেন।’ জ্ঞাতব্য বিষয় এই যে, আল্লাহতা’য়ালা হচ্ছেন واجب الوجود ‘ওয়াজিবুল অজুদ’ বা অবশ্যম্ভাবী অস্তিত্বধারী, অবিনশ্বর। যার আরম্ভ নেই শেষও নেই। সবসময় ছিলেন বরং সময় যখন ছিল না, তখনও তিনি ছিলেন, এখনও আছেন, চিরকালই থাকবেন, যার কোন অন্ত নেই। যিনি অসীমের অসীম। যার কোন লয়, ক্ষয় ও ধ্বংশ নেই। তিনিই হচ্ছেন صمد ‘সামাদ’ বা অমুখাপেক্ষী। অপরদিকে ছরকারে কায়েনাত তাজেদারে মদিনা মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হচ্ছেন ممكن الوجود ‘মমকিনুল অজুদ’ এবং محتاج الى الله একমাত্র আল্লাহ তা’য়ালার দিকেই মুহতাজ বা মুখাপেক্ষী। যেহেতু নূরনবী হচ্ছেন মমকিন বা সম্ভাব্য অস্তিত্বের অধিকারী এবং আল্লাহ হচ্ছেন অজুব বা অবশ্যম্ভাবী অস্তিত্বের অধিকারী। মমকিন বা সম্ভাব্য, উজুব বা অবশ্যম্ভাবী যাতেপাকের সাথে মিশতে পারে না, কেননা এটা উলুহিয়ত বা আল্লাহর গুণে গুনান্বিত হওয়ার মধ্যে গণ্য হয়ে পড়ে। (মাকতুবাতে ইমামে রাব্বানী দ্র:) আল্লাহতা’য়ালার যাতে কারিমা হচ্ছে نور حقيقى নূরে হাকিকী বেনজির বেমিসাল নূর, নূরে মতলক। অর্থ হচ্ছে منور ‘মুনাওইর’ নূর সৃষ্টিকারী। আসমান, জমিন, চন্দ্র, সূর্য, আরশ, করছি, লৌহ, কলম, এককথায় কুল কায়েনাতের স্রষ্টা। হাসান আবু আলীয়া ও দাহহাকসহ এবং একজামাত মুফাসসিরীনে কেরামের অভিমত এর উপর রয়েছে।

আল্লামা রাগেব ইস্পাহানির লিখিত ‘আল মুফরাদাত’ নামক কিতাবের ৫০৮ পৃষ্ঠায় উল্লেখ রয়েছে-

وسمى الله تعالى نفسه نورا من حيث انه هو المنور- قال: (الله نور السموات والارض) 


অর্থাৎ ‘আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তা’য়ালা স্বীয় নাফস বা যাতকে নূর বলে নামকরণ করেছেন এ মর্মে যে, এ নূরের অর্থ হলো منور ‘মুনাওইর’ বা আলোদানকারী। আল্লাহতা’য়ালা এরশাদ করেছেন আল্লাহ আসমান ও জমিনের নূর দানকারী।’ অর্থাৎ আল্লাহ হচ্ছেন হাকিকী নূর আর নবী হচ্ছেন তাখলিকী বা সৃষ্ট নূর। আল্লাহতা’য়ালা তাঁর হেকমতে কামেলার দ্বারা এ নূর মোবারককে সৃষ্টি করে, এর সম্পর্ক সরাসরি আল্লাহর যাত কারিমার দিকে রেখেছেন। এজন্য বলা হয় আল্লাহর যাত কর্তৃক নবীর যাত সৃষ্টি। ষষ্ঠ শতাব্দীর পঞ্চম মুজাদ্দিদ আল্লামা ইমাম গাজ্জালি আলাইহির রহমত (ওফাত ৫০৫ হিজরি) ‘মিশকাতুল আনওয়ার’ নামক একখানা কিতাব প্রণয়ন করেছেন এবং কুরআন সুন্নাহর দলিল আদিল্লাহর মাধ্যমে প্রমাণ করেছেন আল্লাহতা’য়ালাই একমাত্র নূর, নূরে হাকিকী, নূরে মতলক, আল্লাহর যাত হলো নূর এবং আল্লাহ ছাড়া সবই مظلم ‘মুজলিম’ বা অন্ধকার। আল্লাহ যাকে নূর দান করেছেন তিনিই একমাত্র নূর নামে আখ্যায়িত হয়েছেন। আল্লাহর হাবিব নিজেই এরশাদ করেছেন-

اول ما خلق الله نورى 

সর্ব সৃষ্টির পূর্বে আল্লাহতা’য়ালা আমি নবীর নূর মোবারক সৃষ্টি করেছেন, সুতরাং আল্লাহর হাবিব হচ্ছেন আল্লাহতা’য়ালার সৃষ্ট নূর। আর তিনি হচ্ছেন জিনসে বশর বা মানব জাতিতেই এসেছেন। অর্থাৎ তিনি নূরানী মানব। এ সম্পর্কে শায়খ আব্দুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভী আলাইহির রহমত তদীয় مدارج النبوة নামক কিতাবের ১ম খণ্ড পবিত্র কোরআনের আয়াতে কারিমা উল্লেখ করেছেন-

لقد جاء كم رسول من انفسكم عزيز عليه ما انتم حريص عليكم باالمؤمنين رؤوف رحيم- 


অনুবাদ: নিশ্চয় তোমাদের নিকট তাশরিফ এনেছেন তোমাদের জিনস বা যাত থেকে ঐ রাসূল যার নিকটতোমাদের কষ্ট বড়ই কষ্টদায়ক মনে হয়, যিনি তোমাদের কল্যাণ কামনা করে থাকেন। এবং মু’মিনদের প্রতি বড়ই দয়া ও মেহেরবানী প্রদর্শন করে থাকেন। (সূরা তাওবা, আয়াত ১২৮) এ আয়াতের তাফসিরে ‘মাদারিজুন নবুয়ত’ কিতাবের ৭৮-৭৯ পৃষ্ঠায় তিনি বলেন-

بتحقیق آمد شمارا پیغمبری ازذاتھای شما واز جنس شما کہ می شناسید- 


অর্থাৎ নিঃসন্দেহে নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তোমাদের যাত ও তোমাদের জিনস থেকে এসেছেন। অপরদিকে আল্লাহতা’য়ালার যাতে কারিমা ও তাঁর ৮টি সিফাতে কামেলা قديم ‘কাদিম’ যার কোন আরম্ভও নেই শেষও নেই। আল্লাহতা’য়ালা সবসময় ছিলেন, যখন সময় ছিল না তখনও ছিলেন, সবসময় থাকবেন। এ প্রসঙ্গে ইমাম গাজ্জালী আলাইহির রহমত তদীয় ‘এহইয়ায়ে উলুমিদ্দীন’ নামক কিতাবের প্রথম জিলদের ৮৫ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেছেন-

وهو الان على ما عليه كان وانه بائن عن خلقه بصفاته ليس فى ذاته- 


অর্থাৎ ‘তিনি (আল্লাহ) আদিতে যেমনি ছিলেন, এখনও তিনি তেমনিই আছেন। তিনি তাঁর সৃষ্টির নিকট গুণ দ্বারা প্রকাশ, অস্তিত্ব বা জাত দ্বারা নয়।’


চতুর্দশ শতাব্দীর মুজাদ্দিদ ইমাম আহমদ রেজা খাঁন বেরলভী (আলাইহির রহমত) তদীয় الدولة المكية بالمدة الغيبية ‘আদদৌলাতুল মক্বিয়া ফি মাদ্দাতিল গাইবিয়া’ নামক কিতাবের ৩০ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেন-

وذاته سبحانه وتعالى غيرمتناهية وصفاته غيرمتناهيات وكل صفة منها غيرمتناهية وسلاسل الاعداد غيرمتناهية وكذا ايام الابد وساعاته واناله- 


ভাবার্থ: ‘আল্লাহ সুবহানাহু তা’য়ালার যাত বা সত্ত্বা غيرمتناهية সীমাবদ্ধতা হতে পবিত্র (অসীম)। তেমনি তাঁর صفات সিফাত বা গুণাবলীও সীমাবদ্ধতা হতে মুক্ত। তন্মধ্যে আবার প্রতিটি صفة সিফত বা গুণ সীমাবদ্ধতা হতে মুক্ত অর্থাৎ আল্লাহতা’য়ালার যাত ও সিফাতসমূহ বা গুণাবলী গায়ের মুতানাহী বা অসীম যার কোন সীমা নেই। অপরদিকে এগুলোর গণনার ধারাবাহিকতা অসীম। এককথায় আল্লাহ হচ্ছেন وجود وجوب অজুদে উজুব বা অবশ্যম্ভাবী অস্তিত্বধারী। যার কোন আরম্ভ নেই, শেষও নেই, ক্ষয়, লয়, পরিবর্তন, পরিবর্ধন হওয়া অসম্ভব ও হ্রাস-বৃদ্ধি নেই। একমাত্র আল্লাহতা’য়ালা ব্যতীত অজুদে উজুব বা অবশ্যম্ভাবী অস্তিত্বের অধিকারী আর কেউই নেই। অপরদিকে গোটা মাখলুকই হচ্ছে আল্লাহতায়ালার সৃষ্টি। আর মাহবুবে মতলক হাবিবে খোদা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হচ্ছেন اكمل الخلق على الاطلاق পরিপূর্ণ সৃষ্টি। যার নূর বা রূহ মোবারক আল্লাহতা’য়ালার সর্বপ্রথম কোন উপাদান বা মাদ্দা ছাড়াই নিজ কুদরতে কামেলা বা হেকমতে কামেলার দ্বারা সৃষ্টি করেছেন। সুতরাং নবী হচ্ছে ইমকান বা মমকিনুল অজুদ। ফলকথা আল্লাহ হচ্ছেন الوجوب উজুব এবং নবী হচ্ছেন الامكان ইমকান। এজন্য গাউসেপাক রাদিয়াল্লাহু আনহু ইরশাদ করেন-

مقدار قوسى الوجوب والامكان الحافظين لمرتبتى الالوهية والعبودية- 


অর্থাৎ দুই ধনুকের দূরুত্ব পরিমাণ তথা অজুব ও ইমকানের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ অক্ষুন্ন রেখে (আল্লাহ নিরাকার এবং নবী হচ্ছেন সাকার। আল্লাহ হচ্ছেন শ্রষ্টা এবং নবী হচ্ছেন আল্লাহর সর্বপ্রথম সৃষ্ট নূর। আল্লাহ হচ্ছেন معبود ‘মাবুদ’ নবী হচ্ছেন عابد আবিদ আল্লাহর বন্দেগি করলেওয়ালা) উলুহিয়ত ও উবুদিয়তের স্ব-স্ব মর্যাদা অক্ষুন্ন রেখে, হাবিবে খোদা আল্লাহর বন্দেগির মাধ্যমে উলুহিয়ত বা আল্লাহর নিকট উবুদিয়তের অধিক মর্যাদায় অধিষ্টিত হলেন। এককথায় নবী আলাইহিস সালাম সৃষ্টির মধ্যে অতুলনীয় আল্লাহর নৈকট্য লাভে আল্লাহতা’য়ালার দিদারে ধন্য হলেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেহেতু মমকিনুল অজুদ, যার পরিবর্তন, পরিবর্ধন, ক্ষয়, লয় হওয়া সম্ভব। উজুব ও ইমকানের মধ্যে ইত্তেহাদ ও হুলুল হওয়া অসম্ভব। সুতরাং নবী মি’রাজ রজনীতে আল্লাহর যাতের সঙ্গে মিশে গেছেন অথবা আল্লাহ ও রাসূল উভয় اتحاد ইত্তেহাদ বা এক হয়ে গেছেন এরূপ আকিদা রাখা কুফুরি ও শিরকি বৈ কিছুই নয়। কেউ কেউ ওয়াজ মাহফিলে ও বক্তৃতায় বলে থাকেন- ‘মি’রাজ রজনীতে আল্লাহর হাবিব এমনভাবে আল্লাহর সত্ত্বার সাথে মিশে গেছেন যেমন চিনি পানিতে মিশে যায়।’ এরূপ আকিদা ঈমান বিধ্বংশী আকিদা, এসব আকিদাহ যেন আমাদের মধ্যে না থাকে সে দিকে সতর্ক থাকতে হবে। এ সংক্রান্ত বিষয়ে আরো কিছু সংক্ষিপ্ত আলোচনা প্রদত্ত হলো- ১. মুনতাখাবাত আয মাকতুবাতে ইমামে রাব্বানী নামক গ্রন্থের ২৭৬ পৃষ্ঠায়, ৬৭ নম্বর মাকতুবে উল্লেখ রয়েছে-

او تعالی با ھیچ چیز متحذ نشود وھیچ چیز باوے متحد نگردد و نیز ھیچ چیز دروے تعالی حلول نکند اوتعالی درھیچ چیز حلول نشود وتبعض وتجروی در جناب قدس اوتعالی مجالست وترکیب وتحلیل دران حضرت جل شانہ ممنوع ست الخ 


ভাবার্থ: হযরত উমর ফারুক রাদিয়াল্লাহু আনহু এর বংশের উজ্জ্বল নক্ষত্র একাদশ শতাব্দীর দশম মুজাদ্দিদ শায়খ আহমদ সিরহিন্দী মুজাদ্দিদে আলফেসানী আলাইহির রহমত (ওফাত ১০৩৪ হিজরি) বলেন- ‘আল্লাহতা’য়ালা কোন বস্তুর সাথে একীভূত হন না এবং কোন বস্তু তাঁর সাথে এক হয়ে যায় না। আল্লাহ তা’য়ালা কোন বস্তুর ভিতর অনুপ্রবেশ করেন না এবং কোন বস্তুও আল্লাহর ভিতরে অনুপ্রবেশ করতে পারে না।আল্লাহ তা’য়ালার জন্য খণ্ড- ও অংশ হওয়া অসম্ভব। তারকিব বা সংমিশ্রণ, তাহলিল বা দ্রবীভূত হওয়া তাঁর পাক জাতে মামনুউ বা নিষিদ্ধ।’ উপরোক্ত আলোচনা দ্বারা স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হলো, আল্লাহতা’য়ালার সত্ত্বার সাথে কেউ মিশতে পারবে না। সুতরাং চিনি যেমন পানিতে মিশে যায় তেমনি আল্লাহর রাসূল মি’রাজশরীফে আল্লাহর সত্ত্বার সাথে মিশে গেছেন এ আকিদা ঈমান বিধ্বংশী আকিদা।


২. হযরত মুজাদ্দিদে আলফেসানী রাদিয়াল্লাহু আনহু তদীয় مكتوبات امام ربانى ‘মাকতুবাতে ইমামে রাব্বানী’ নামক কিতাবের তৃতীয় জিলদের ১২২ নং মকতুবে করেছেন-

آنحضرت صلی اللہ علیہ وسلم بھی اس جاہ وجلال اور اس بلندی شان کے با وجود ہمیشہ ممکن ہیں اور ہرگز امکان سے باہر نہیں آسکتے اور نہ واجب سے مل سکتے کیونکہ یہ الوھیت سے متصف ہونے کو مستلزم ہے اور تعالی اس سے بلند ھے کہ کوئ اسکا شریک اور برابری کرنے والا ہو- دع ما ادعتہ النصاری فی نبیھم واحکم بما شئت مدحا فیہ واحتکم 


ভাবার্থ: হযরত মোহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সৃষ্টির মধ্যে সর্বোচ্চ শান শওকতের ও কুলকায়েনাতের সর্বোচ্চ মর্যাদা সম্পন্ন হওয়া সত্ত্বেও সবসময় (চিরকালই) তিনি হচ্ছেন ممكن ‘মমকিন’ বা সম্ভাব্য। নিশ্চয় নূর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ممكن ‘মমকিন’ বা সম্ভাব্য হতে নিস্কৃতি লাভ করেননি এবং আল্লাহতা’য়ালা যিনি واجب الوجود ‘ওয়াজিবুল ওজুদ’ বা অবশ্যম্ভাবী জাতে পাকের সাথে তিনি মিলিত হতে পারেন না, এ জন্য যাতে উলুহিয়াতের (আল্লাহর) সাথে মিলিত হওয়া অনিবার্য হয়ে পড়ে। কারণ আল্লাহতা’য়ালা তাঁর সমকক্ষ ও শরিক হওয়া হতে তিনি অতি উচ্চ ও পবিত্র। কহিল নাছারা যাহা স্বীয় নবীর পরে কহিও না তোরা তাহা মম নবী বরে। মুজাদ্দিদে আলফেসানী আলাইহির রহমতের উপরোক্ত দলিলভিত্তিক আলোচনা দ্বারা স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হলো- ক. আল্লাহ হচ্ছেন ওয়াজিবুল ওজুদ বা অবিনশ্বর, অবশ্যম্ভাবী অস্তিত্বের অধিকারী। যাকে উজুব বলা হয়ে থাকে। খ. নবী হচ্ছেন ممكن الوجود বা সম্ভাব্য অস্তিত্বের অধিকারী যাকে ইমাকানও বলা হয়ে থাকে। গ. হাবিবে খোদা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামসহ আল্লাহর সকল সৃষ্টিজগতই ইমকান। ইমকান কস্মিনকালেও অজুব বা আল্লাহতা’য়ালার যাতের সাথে মিশতে পারে না। কেননা ইমকান আল্লাহর যাতের সাথে মিশার অর্থ হলো উলুহিয়ত স্বীকার করা অনিবার্য হয়ে পরে। সুতরাং প্রকৃত অর্থে নবী আল্লাহর যাতের সঙ্গে মিশে গেছেন যেমন চিনি পানিতে মিশে যায় এরূপ বলা তাওহিদী আকিদার পরিপন্থী। ৩. চতুর্দশ শতাব্দীর মুজাদ্দিদ আ’লা হযরত ইমাম আহমদ রেজা খাঁন বেরলভী আলাইহির রহমত ‘সিলাতুস সাফা ফি নুরিল মোস্তফা’ নামক কিতাবে লিখেছেন-

اللہ عز وجل حصے اور ٹکرے اور کسی کے ساتھے متحد ہو جانے یاکسی میں حلول فرمانے سے پاک و منزہ ہے حضور سید عالم صلی اللہ علیہ وسلم خواہ کسی شئ کو جزء ذات الھی خواہ کسی مخلوق کو عین ونفس ذات ماننا کفر ہے- 


ভাবার্থ: মহান আল্লাহ আজ্জা ওয়া জাল্লা অংশ, টুকরো এবং কোন কিছুর সাথে একীভূত হওয়া অথবা কোন বস্তুর মধ্যে হুলুল বা অনুপ্রবেশ হওয়া থেকে পবিত্র। হুজুর সায়্যিদে আলম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এমনকী কোন বস্তুকে আল্লাহর যাতের অংশ এমনকী কোন সৃষ্টিকে প্রকৃত জাত ও নফসে যাতে এলাহি মানা বা আকিদা রাখা কুফুরি। ইমামে আহলে সুন্নাত আ’লা হযরতের উপরোক্ত বক্তব্যের দ্বারা স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হলো, আল্লাহতায়ালার যাতে কারিমা এমন একটি নূর যার কোন উদাহরণ বা মিসাল নেই। বেনজির বেমিসাল নূর, নূরে হাকিকী, যে নূরের অংশ হয় না, ভাগ হয় না, টুকরো হয় না, লাল, হলুদ, সবুজ এককথায় সৃষ্টির মধ্যে যার কোন তুলনা নেই। মোটকথা আল্লাহর নূর হলো নূরে হাকিকী এবং রাসূলেপাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নূর হলো নূরে তাখলিকী বা আল্লাহর সৃষ্ট নূর। আ’লা হযরতের এ ফতওয়ার আলোকে বুঝা গেল যে, মি’রাজ রজনীতে আল্লাহ আজ্জা ওয়া জাল্লার সাথে হাবিবে খোদা একীভূত হওয়া বা মিশে যাওয়া অথবা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর যাতের মধ্যে হুলুল বা অনুপ্রবেশ করা, এরূপ আকিদা নিঃসন্দেহে কুফুরি।


মুদ্দাকথা হলো হুজুর পুরনূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মি’রাজ রজনীতে আল্লাহর যাত বা সত্ত্বার সাথে মিশে গেছেন এ আকিদা রাখা কুফুরি। একটি প্রবাদ রয়েছে- নূরে নূরে মিল গিয়া হায় ওয়াসতা মে পর্দা নিহি। এধরনের কথা বলা যাবে না। ‘মুন্তাখাবাত আজ মাকতুবাতে ইমামে রাব্বানী’ নামক কিতাবের ১৪৯ পৃষ্ঠায় (মাকতুব নং ২৬৬) উল্লেখ রয়েছে-

اوتعالی قدیم وازلی است وغیر اورا قدیم وازلیت ثابت نبود جمیع ملتیں بریں حکم اجماع فرمودہ اند وہر کسیکہ بقدم و آزلیت غیر حق جل وعلا قائل گشتہ است تکفیر او نمودہ اند- 


অর্থাৎ আল্লাহ আজ্জা ওয়া জাল্লা কাদিম ও আজলি অর্থাৎ অনাদি ও অনন্ত, যার আরম্ভও নেই এবং শেষও নেই। তিনি ব্যতীত অন্য কাউকে কেদাম ও আজলিয়ত বা অনাদি অনন্ত বলে আকিদা রাখা যাবে না। এর উপরই সকল মুসলমানগণের ইজমা বা ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। যদি কেউ আল্লাহ ব্যতীত অন্য কাউকে কেদাম ও আজলিয়ত বা অনাদি অনন্ত বলে আকিদা পোষন করে তবে সে কাফের হয়ে যাবে। উপরোক্ত দলিলভিত্তিক আলোচনা দ্বারা স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হলো- একমাত্র আল্লাহ আজ্জা ওয়া জাল্লাই قديم وازلى কাদিম ও আজলি, আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে কাদিম ও আজলি বলে আকিদা পোষণ করলে নিঃসন্দেহে কাফের সাব্যস্থ হবে। সারকথা হলো- আল্লাহ হচ্ছেন কাদিম ও আজলি, নবী হচ্ছেন তুলনাবিহীন হাদেছ, আল্লাহ হচ্ছেন وجوب নবী হচ্ছেন امكان ইমকান। ইহাই হলো আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের আকিদা। ৪. ‘তাফসিরে হাসান বসরী’ নামক কিতাবের পঞ্চম জিলদের ৮৩ পৃষ্ঠায় উল্লেখ রয়েছে- 

قوله تعالى : (ثم دنا فتدلى) الاية ১৫৬৫- حدثنا عبد الرزاق عن معمر عن الحسن وقتادة فى قوله (ثم دنا فتدلى): قالا هو جبرائيل عليه السلام- حاشيه (১) عبد الرزاق ص ১৪৪- الف الاسناد صحيح 

ভাবার্থ: হযরত হাসান বসরী রাদিয়াল্লাহু আনহু সহিহ ইসনাদ সংবলিত হাদিসশরীফের মাধ্যমে উল্লেখ করেন আল্লাহর কালাম ثم دنا فتدلى ‘সুম্মা দানা ফাতাদাল্লা’ এ আয়াতে কারিমার অর্থ হলো- হযরত জিব্রাইল আলাইহিস সালাম আল্লাহর হাবিবের নিকটবর্তী হলেন। আল্লামা আশ শায়খ ইসমাইল হক্বী বরসয়ী আলাইহির রহমত (ওফাত ১১৩৭ হিজরি) তদীয় تفسير روح البيان ‘তাফসিরে রুহুল বয়ান’ নামক কিতাবের নবম জিলদের ২১৭ পৃষ্ঠায়- ثم دنا فتدلى فكان قاب قوسين এ আয়াতে কারিমার তাফসিরে উল্লেখ করেছেন- 

وفى معالم التنزيل معنى قوله كان بين جبرئيل ومحمد عليهما السلام مقدار قوسين انه كان بينهما مقدار ما بين الوتر والقوس كأنه غلب القوس على الوتر وهذا اشارة الى تأكيد القرب- 


ভাবার্থ: তাফসিরে মুয়ালিমুত তানযিল এ উপরোক্ত আয়াতে কারিমার ভাবার্থ বর্ণনা করা হয়েছে, হযরত জিব্রাইল আলাইহিস সালাম হাবিবে খোদার নিকটবর্তী হলেন। অর্থাৎ হযরত জিব্রাইল আলাইহিস সালাম ও হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মধ্যে দুই ধনুকের দূরুত্ব বরাবর দূরত্ব ছিল। ফলকথা অধিক নিকটবর্তী হওয়ার দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে।’ উপরোক্ত দলিলভিত্তিক আলোচনা দ্বারা প্রমাণিত হলো- ثم دنا فتدلى الخ ‘সুম্মা দানা ফাতাদাল্লা’ এ আয়াতে কারিমার অর্থ হলো হযরত জিব্রাইল আলাইহিস সালাম হাবিবে খোদার নিকটবর্তী হলেন।


অনুরূপ ‘নাসিমুর রিয়াজ ফি শরহে শিফা কাজী আয়াজ’ নামক কিতাবের প্রথম জিলদের ২১৭ পৃষ্ঠায় আল্লামা আহমদ শিহাবুদ্দিন খুফফাজী মিশরী আলাইহির রহমত (বেলাদত ৪৩১ হিজরি, ওফাত ৫৪৪ হিজরি) উল্লেখ করেছেন-


(والقرب والدنو) لقوله تعالى (ثم دنى فتدلى فكان قاب قوسين او ادنى) على القول بان الضمير النبى صلى الله عليه وسلم وليس هذا قربا مكانيا ان كان المرادبه من القرب من الله تعالى لاستحالة المكان والجهة على الله وقد ذكر فى الاية على سبيل المدح فالاول فى قوله تعالى (فكان قاب قوسين او ادنى) والثانى فى قوله تعالى (ثم دنى) فهما متغائران هنا أو هو عطف تفسير- 

ভাবার্থ: ‘কুরব বা সান্বিধ্য ও দুনুউ বা নিকটবর্তী হওয়া’ এ সম্পর্কে আল্লাহতা’য়ালার এরশাদ-

ثم دنى فتدلى فكان قاب قوسين او ادنى 


অর্থাৎ‘ হযরত জিব্রাইল আলাইহিস সালাম আল্লাহর হাবিবের নিকটবর্তী হলেন। কেউ কেউ বলেছেন হাবিবে খোদা আল্লাহর নিকটবর্তী হয়েছেন। অর্থাৎ তিনি আল্লাহর দরবারে নৈকট্য অর্জন করেছেন। নৈকট্যের কারণে দুই ধনুকের সমান দূরুত্ব অবশিষ্ট ছিল বরং অর্ধ্ব ধনুকের দূরুত্ব অবশিষ্ট ছিল। যদি ধরে নেওয়া হয় আল্লাহর হাবিব আল্লাহর নিকটবর্তী হয়েছেন, এমতাবস্থায় ‘কুরব’ বা নিকটবর্তী হওয়া কুরবে মাকান অর্থ নেয়া যাবে না। কেননা আল্লাহর জন্য মাকান ও দিক সবকিছুই অসম্ভব। আয়াতে কারিমার মধ্যে যা বর্ণনা করা হয়েছে তা শুধুমাত্র হাবিবে খোদা যে আল্লাহর নিকট অধিক প্রিয় এর ইঙ্গিত বহন করে। এখানে কুরব বা নিকটতম হওয়া কুরবে মাকান নয় বরং কুরবে মুদহে বা নবীকে যে আল্লাহ কামালে মুহব্বত করেছেন তারই নিদর্শন। এককথায় মি’রাজ রজনীতে আল্লাহর হাবিব আল্লাহর দরবারে অধিক নৈকট্য লাভ করেছেন এবং কপালের চোখ মোবারক দ্বারা নিরাকার আল্লাহর দিদারে ধন্য হয়েছেন। মোদ্দাকথা হলো قاب قوسين او ادنى এর মধ্যে যে নৈকট্যের বর্ণনা রয়েছে, সুফিগণ তাকে ‘ফানায়ে তাম’ পূর্ণ ফানা বলে ব্যক্ত করেছেন। এতে নবীর শান যে সৃষ্টির মধ্যে অতুলনীয় তারই প্রমাণ।


মি’রাজ ঈমানের কষ্টি পাথর

ঈমানদারের জন্য মি’রাজের ঘটনা ঈমানের একটি কষ্টিপাথর। যে ব্যক্তি আল্লাহ আজ্জা ওয়া জাল্লার যাত বা সত্ত্বা, সিফাত বা আল্লাহর গুণাবলী, অসীম জ্ঞান ও কুদরত মহাত্ম্য ও প্রজ্ঞার প্রতি পরিপূর্ণ ঈমান রাখে এবং হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নবুয়ত ও রিসালাত, সততা এবং সৃষ্টির মধ্যে অতুলনীয় মর্যাদাকে আন্তরিকভাবে বিশ্বাস করে। সে ব্যক্তি মি’রাজুন নবীর মতো সত্য ঘটনা বা এ জাতীয় অলৌকিক বিষয়াবলী কখনই অস্বীকার করতে পারে না। যখন কুরআন ও সুন্নায় তার সুষ্পষ্ট ও দ্বার্থহীন বর্ণনা রয়েছে। নবুয়তের কাল থেকে আরম্ভ করে প্রত্যেক যুগের সকল মুসলমান মি’রাজ এর মত একটি অতুলনীয় মু’জিযাকে কুটিল ব্যাখ্যা ছাড়াই স্বীকার করে আসছেন ।


[1]. মক্কা থেকে বাইতুল মাকদিস পর্যন্ত ভ্রমণকে ইসরা বলা হয়। এটি হয়েছিল বুরাকের উপর আরোহন অবস্থায়। আর বাইতুল মাকদিস থেকে সাত আসমান পর্যন্ত ভ্রমণকে বলা হয় মিরাজ। এটি হয়েছিল সিড়ির মাধ্যমে। (আল্লাহই ভাল জানেন)

[2]. মি’রাজের রাত্রিতে নাবী সাঃ) যে সমস্ত নিদর্শন দেখেছেন

মেরাজের উদ্দেশ্য সম্পর্কে আল্লাহ্ তা‘আলা বলেনঃ لِنُرِيَهُ مِنْ آيَاتِنَا (মিরাজ সংঘটিত হয়েছিল) তাঁকে আমার নিদর্শন দেখাবার জন্যে। (সূরা বাণী ইসরাঈল-১৭:১) নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এই রাত্রিতে অসংখ্য বড় বড় নিদর্শন দেখেছেন। তম্মধ্যেঃ


১. মানব জাতির পিতা আদম আঃ) কে দেখেছেন। তার ডান পাশে ছিল শহীদদের (জান্নাতীদের) রূহ এবং বাম পাশে ছিল জাহান্নামীদের রূহ।


২. রসূল সাঃ) বলেনঃ অতঃপর আমার সামনে বায়তুল মামূর উম্মুক্ত করা হলো। বায়তুল মামূর সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে জিবরীল বললেন- এটি হলো বায়তুল মামূর। এতে প্রতিদিন সত্তর হাজার ফেরেশতা সলাত আদায় করে। এক বার যে সেখান থেকে বের হয়ে আসে কিয়ামতের পূর্বে সে আর তাতে প্রবেশের সুযোগ পাবেনা।


৩. রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন- অতঃপর আমার জন্যে সিদরাতুল মুনতাহা তথা সিমামেত্মর কূল বৃক্ষ উম্মুক্ত করা হল। এই বৃক্ষের ফলগুলো ছিল কলসীর ন্যায় বড়। গাছের পাতাগুলো ছিল হাতীর কানের মত বৃহদাকার।


৪. তিনি গাছের গোড়াতে চারটি নদী দেখতে পেলেন। দু'টি চলে গেছে ভিতরের দিকে এবং দুটি চলে গেছে বাহিরের দিকে। জিবরীলকে আমি এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেন- ভিতরের দিকে প্রবাহিত নদী দুটি জান্নাতে চলে গেছে এবং বাহিরের নদী দুটি হলো ফোরাত ও নীল। ফোরাত ও নীল দেখার অর্থ হল নাবী সাঃ) এর মিশন অচিরেই ঐ নদী দুটির অঞ্চলে পৌঁছে যাবে এবং ঐ সমস্ত অঞ্চলের অধিবাসীরা যুগে যুগে ইসলামের পতাকা বহন করবে। অর্থ এই নয় যে এদু’টি নদী জান্নাত থেকে বের হয়ে এসেছে।


৫. মিরাজের রাত্রিতে তিনি সিদরাতুল মুনতাহায় জিবরীল ফেরেশতাকে আসল আকৃতিতে দেখলেন। অথচ ইতিপূর্বে তিনি আরেকবার দুনিয়াতে তাঁকে দেখেছিলেন।


৬. তিনি বে-সলাতীর শাস্তি দেখেছেন। সহীহ বুখারীতে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর দীর্ঘ হাদীছে এসেছে, 


وَإِنَّا أَتَيْنَا عَلَى رَجُلٍ مُضْطَجِعٍ وَإِذَا آخَرُ قَائِمٌ عَلَيْهِ بِصَخْرَةٍ وَإِذَا هُوَ يَهْوِي بِالصَّخْرَةِ لِرَأْسِهِ فَيَثْلَغُ رَأْسَهُ فَيَتَهَدْهَدُ الْحَجَرُ هَا هُنَا فَيَتْبَعُ الْحَجَرَ فَيَأْخُذُهُ فَلَا يَرْجِعُ إِلَيْهِ حَتَّى يَصِحَّ رَأْسُهُ كَمَا كَانَ ثُمَّ يَعُودُ عَلَيْهِ فَيَفْعَلُ بِهِ مِثْلَ مَا فَعَلَ الْمَرَّةَ الْأُولَى

‘‘আমরা এক শায়িত ব্যক্তির কাছে আসলাম। তার মাথার কাছে পাথর হাতে নিয়ে অন্য একজন লোক দাড়িয়ে ছিল। দাঁড়ানো ব্যক্তি শায়িত ব্যক্তির মাথায় সেই পাথর নিক্ষেপ করছে। পাথরের আঘাতে তার মাথা চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যাচ্ছে এবং পাথরটি বলের মত গড়িয়ে অনেক দূরে চলে যাচ্ছে। লোকটি পাথর কুড়িয়ে আনতে আনতে আবার তার মাথা ভাল হয়ে যাচ্ছে। দাঁড়ানো ব্যক্তি প্রথমবারের মত আবার আঘাত করছে এবং তার মাথাকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দিচ্ছে।

রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর সফরসঙ্গী ফেরেশতাকে জিজ্ঞেস করলেনঃ কি অপরাধের কারণে তাকে এভাবে শাস্তি দেয়া হচ্ছে? উত্তরে তারা বললেনঃ এব্যক্তি কুরআন শিক্ষা করেছিল। কিন্তু কুরআন অনুযায়ী আমল করেনি এবং সে ফরজ সলাতের সময় ঘুমিয়ে থাকত। কিয়ামত পর্যন্ত তাকে এভাবে শাস্তি দেয়া হবে। (সহীহ বুখারী তাও হা/৭০৪৭)


৭. তিনি সুদখোরের শাস্তি দেখেছেন। সহীহ বুখারীতে সামুরা বিন জুনদুব  হতে বর্ণিত হয়েছে রসূল সাঃ) এর দীর্ঘ হাদীছে এসেছে, 

فَأَتَيْنَا عَلَى نَهَرٍ حَسِبْتُ أَنَّهُ كَانَ يَقُولُ أَحْمَرَ مِثْلِ الدَّمِ وَإِذَا فِي النَّهَرِ رَجُلٌ سَابِحٌ يَسْبَحُ وَإِذَا عَلَى شَطِّ النَّهَرِ رَجُل قَدْ جَمَعَ عِنْدَهُ حِجَارَةً كَثِيرَةً وَإِذَا ذَلِكَ السَّابِحُ يَسْبَحُ مَا يَسْبَحُ ثُمَّ يَأْتِي ذَلِكَ الَّذِي قَدْ جَمَعَ عِنْدَهُ الْحِجَارَةَ فَيَفْغَرُ لَهُ فَاهُ فَيُلْقِمُهُ حَجَرًا فَيَنْطَلِقُ يَسْبَحُ ثُمَّ يَرْجِعُ إِلَيْهِ كُلَّمَا رَجَعَ إِلَيْهِ فَغَرَ لَهُ فَاهُ فَأَلْقَمَهُ حَجَرًاগ্ধ

‘‘আমরা একটি রক্তের নদীর কাছে আসলাম। দেখলাম নদীতে একটি লোক সাঁতার কাটছে। নদীর তীরে অন্য একটি লোক কতগুলো পাথর একত্রিত করে তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। সাঁতার কাটতে কাটতে লোকটি যখন নদীর কিনারায় পাথরের কাছে দাড়ানো ব্যক্তির নিকটে আসে তখন দাড়ানো ব্যক্তি তার মুখে একটি পাথর ঢুকিয়ে দিচ্ছে। পাথর মুখে নিয়ে লোকটি আবার সাঁতরাতে শুরু করে। যখনই লোকটি নদীর তীরে আসতে চায় তখনই তার মুখে পাথর ঢুকিয়ে দেয়। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামএর কারণ জানতে চাইলে ফেরেশতাদ্বয় বললেনঃ এরা হলো আপনার উম্মতের সুদখোর’’। (সহীহ বুখারী মাশা হা/৬৬৪০)

৮. তিনি ইয়াতীমের মাল আত্মসাৎকারীকেও দেখেছেন। তাদের ঠোঁটের আকার আকৃতি ছিল উটের ঠোঁটের মত। তারা পাথরের টুকরোর মত আগুনের ফুলকী মুখের মধ্যে পুরতেছিল এবং সেগুলো পায়খানার রাস্তা দিয়ে বের হচ্ছিল।

৯. তিনি ব্যভিচারী নারী পুরুষের শাস্তি দেখেছেন। সহীহ বুখারীতে সামুরা বিন জুনদুব  হতে বর্ণিত, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামএর দীর্ঘ হাদীছে কবরে ব্যভিচারীর ভয়াবহ শাস্তির বর্ণনা এসেছে। তিনি বলেনঃ ্র

فَأَتَيْنَا عَلَى مِثْلِ التَّنُّورِ قَالَ فَأَحْسِبُ أَنَّهُ كَانَ يَقُولُ فَإِذَا فِيهِ لَغَطٌ وَأَصْوَاتٌ قَالَ فَاطَّلَعْنَا فِيهِ فَإِذَا فِيهِ رِجَالٌ وَنِسَاءٌ عُرَاةٌ وَإِذَا هُمْ يَأْتِيهِمْ لَهَبٌ مِنْ أَسْفَلَ مِنْهُمْ فَإِذَا أَتَاهُمْ ذَلِكَ اللهَبُ ضَوْضَوْاগ্ধ

‘‘আমরা একটি তন্দুর চুলার নিকট আসলাম। যার উপরিভাগ ছিল সংকীর্ণ এবং ভিতরের অংশ ছিল প্রশস্ত। তার ভিতরে আমরা কান্নার আওয়াজ শুনতে পেলাম। দেখতে পেলাম তাতে রয়েছে কতগুলো উলঙ্গ নারী-পুরুষ। তাদের নিচের দিক থেকে আগুনের শিখা প্রজ্বলিত করা হচ্ছে। অগ্নিশিখা প্রজ্ববলিত হওয়ার সাথে সাথে তারা উচ্চঃস্বরে চিৎকার করছে। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর কারণ জানতে চাইলে ফেরেশতাদ্বয় বললেনঃ এরা হলো আপনার উম্মতের ব্যভিচারী নারী-পুরুষ’’। (বুখারী)


ব্যভিচারীর শাস্তির অন্য একটি চিত্র

নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মিরাজের রাত্রিতে একদল লোকের কাছে উপস্থিত হয়ে দেখতে পেলেন তাদের সামনে একটি পাত্রে গোশত রান্না করে রাখা হয়েছে। অদূরেই অন্য একটি পাত্রে রয়েছে পঁচা দুর্গন্ধযুক্ত কাঁচা গোশত। লোকদেরকে রান্না করে রাখা গোশত থেকে বিরত রেখে পঁচা এবং দুর্গন্ধযুক্ত, কাঁচা গোশত খেতে বাধ্য করা হচ্ছে। তারা চিৎকার করছে এবং একান্ত অনিচ্ছা সত্বেও তা থেকে ভক্ষণ করছে। নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জিবরীল ফেরেশতাকে জিজ্ঞেস করলেনঃ এরা কোন শ্রেণীর লোক? জিবরীল বললেনঃ এরা আপনার উম্মতের ঐ সমস্ত পুরুষ লোক যারা নিজেদের ঘরে পবিত্র এবং হালাল স্ত্রী থাকা সত্বেও অপবিত্র এবং খারাপ মহিলাদের সাথে রাত্রি যাপন করত। (আল-খুতাবুল মিম্বারিয়াহ, ডঃ সালেহ ফাওযান) এই হাদীসের মূল বিষয় বস্ত্ত অন্য এক বিশুদ্ধ হাদীছ দ্বারা সাব্যস্ত। তবে উল্লেখিত হাদীসটি দুর্বল।


৯) তিনি জান্নাত ও জাহান্নাম দেখেছেন ।

১০) তিনি সেই রাত্রে জাহান্নামের প্রহরী মালেক ফেরেশতাকে দেখেছেন। তাঁর দিকে ফিরে তাকাতেই তিনি আমাকে প্রথমেই সালাম দিলেন। (বুখারী, কিতাবু আহাদীছুল আম্বীয়া, হা/৩১৮২, মুসলিম, অধ্যায়ঃ কিতাবুল ঈমান, হা/২৫১)

১১) বায়তুল মাকদিসে নাবীদের ইমাম হয়ে সলাত পড়েছেন। নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সকালে ঘুম থেকে উঠে সে রাত্রিতে দেখে আসা নিদর্শনসমূহ সম্পর্কে যখন কুরাইশদেরকে সংবাদ দিলেন, তখন তারা এই ঘটনাকে মিথ্যা বলে উড়িয়ে দিল। নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামএর উপর তারা অত্যাচারের মাত্রা আরও বাড়িয়ে দিল। তারা তাঁর নিকট বায়তুল মাকদিসের বর্ণনা পেশ করার দাবী জানালো। আল্লাহ বায়তুল মাকদিসের দৃশ্য তার চোখের সামনে উম্মুক্ত করলেন। নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দেখে দেখে সেখানকার সকল নিদর্শন বলে দিলেন। তারা একটি কথাও অস্বীকার করতে পারলনা।


আবূ হুরায়রা  হতে বর্ণিত, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ আমি একদা কাবার প্রাঙ্গনে ছিলাম। কুরাইশরা আমাকে বায়তুল মাকদিসের এমন জিনিষ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করল যা আমার স্মরণ ছিলনা। এতে আমি সংকটে পড়ে গেলাম। নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ আল্লাহ আমার জন্যে বায়তুল মাকদিসকে চোঁখের সামনে উঠিয়ে ধরলেন। দেখে দেখে আমি তাদের সকল প্রশ্নের উত্তর দিয়ে দিলাম।

মি’রাজের শিক্ষাঃ

১) ঈমানী পরীক্ষাঃ

নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বায়তুল মাকদিস ভ্রমণ করে এসে সকালে মানুষের কাছে তা বলতে শুরু করলেন। এ ঘটনা শুনে কতিপয় দুর্বল ঈমানদার মুরতাদ হয়ে গেল। মুশরিকদের কিছু লোক দৌড়িয়ে আবূ বকর (রাঃ) এর নিকট গিয়ে বললঃ তোমার বন্ধুর খবর শুনবে কি? সে বলছে, আজ রাতের ভিতরেই সে নাকি বায়তুল মাকদিস ভ্রমণ করে চলে এসেছে। তিনি বললেনঃ আসলেই কি মুহাম্মাদ তা বলছে? তারা এক বাক্যে বললঃ হ্যাঁ। তিনি বললেনঃ যদি বলেই থাকে, তাহলে সত্য বলেছেন। তারা আবার বললঃ তুমি কি বিশ্বাস কর যে, সে এক রাতের ভিতরে বায়তুল মাকদিস ভ্রমণ করে সকাল হওয়ার পূর্বেই আবার মক্কায় চলে এসেছে? উত্তরে তিনি বললেনঃ আমি এর চেয়েও দূরের সংবাদকে বিশ্বাস করি। তাঁর কাছে সকাল-বিকাল আকাশ থেকে সংবাদ আসে। আমি তা বিশ্বাস করি। সে দিনই আবূ বকর (রাঃ) কে পরম সত্যবাদী তথা সিদ্দীক উপাধীতে ভূষিত করা হয়। (হাকেম, তৃতীয় খন্ড, পৃষ্ঠা নং- ৮১, হা/ ৩১৮২, ইমাম আলবানী হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন)

২) দাঈদের জন্য শিক্ষাঃ

মিরাজের ঘটনায় দ্বীনের দাঈদের জন্য এক বিশেষ শিক্ষা রয়েছে। তিনি প্রচারক মিরাজ থেকে ফেরত এসে মানুষের কাছে ঘটনা খুলে বলতে ইচ্ছা প্রকাশ করলে উম্মে হানী বিনতে আবু তালেব (রাঃ) তাঁকে বললেনঃ আমার আশঙ্কা হচ্ছে, লোকেরা আপনাকে মিথ্যাবাদী বলবে। নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তখন বললেনঃ আল্লাহর শপথ! আমি অবশ্যই তাদের কাছে ঘটনা খুলে বলবো। আমাকে তারা মিথ্যাবাদী বললেও। সুতরাং দ্বীনের দাঈগণের উচিত, সত্য প্রকাশের ক্ষেত্রে তারা কোন প্রকার দ্বিধাবোধ করবে না এবং মানুষ সেটাকে গ্রহণ করবে কি করবে না- এ ধরণের কোন চিন্তা-ভাবনা করবে না; বরং বলিষ্ঠ কন্ঠে মানুষের সামনে সত্যকে তুলে ধরবে।

৩) পাঁচ ওয়াক্ত সলাত ফরয হয়ঃ

মেরাজের রাতে পঞ্চাশ ওয়াক্ত সলাত ফরজ করা হয়েছে। মিরাজ থেকে ফেরত আসার সময় ৬ষ্ঠ আসমানে মূসা আঃ) এর সাথে সাক্ষাৎ হল। মূসা আঃ) জিজ্ঞেস করলেনঃ আপনি আপনার প্রভুর পক্ষ হতে কি নিয়ে আসলেন? নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেনঃ আমার উপর পঞ্চাশ ওয়াক্ত সলাত ফরজ করা হয়েছে। মূসা আঃ) বলেনঃ আমি মানুষের অবস্থা তোমার চেয়ে অনেক বেশী অবগত। বানী ইসরাঈলকে আমি ভালভাবেই পরীক্ষা করে দেখেছি। তোমার উম্মাত পঞ্চাশ ওয়াক্ত সলাত পড়তে পারবে না। তুমি ফেরত যাও এবং কমাতে বল। নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ আমি মূসা আঃ) এর পরামর্শ মোতাবেক ফেরত গিয়ে কমাতে বললাম। চল্লিশ করা হলো। আবার মূসা আলাইহিস সালামের পরামর্শ মোতাবেক ২য় বার আবদারের প্রেক্ষিতে ত্রিশ করা হলো। পুনরায় যাওয়ার প্রেক্ষিতে বিশ ওয়াক্ত করে দেয়া হলো। অতঃপর দশে পরিণত হলো। মূসা আঃ) এর কাছে দশ ওয়াক্ত নিয়ে ফেরত আসলে তিনি আবার যেতে বললেন। এবার পাঁচ ওয়াক্ত করা হলো। নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ পাঁচ ওয়াক্ত সলাত নিয়ে মূসা আঃ) এর কাছে আগমণ করলাম। তিনি আমাকে আবার যেতে বললেন। আমি তাঁকে বললামঃ আমি গ্রহণ করে নিয়েছি। তখন আল্লাহর পক্ষ হতে ঘোষণা করা হলোঃ আমার ফরজ ঠিক রাখলাম। কিন্তু বান্দাদের উপর থেকে সংখ্যা কমিয়ে দিলাম। আর আমি প্রতিটি সৎআমলের বিনিময় দশ পর্যন্ত বাড়িয়ে দিব। অর্থাৎ কোন ব্যক্তি পাঁচ ওয়াক্ত সলাত সঠিকভাবে আদায় করলে তাকে পঞ্চাশ ওয়াক্তের ছওয়াব দেয়া হবে। (বুখারী, অধ্যায়ঃ কিতাবু বাদইল খাল্ক, হা/ ৪৪৫৮, মুসলিম, অধ্যায়ঃ কিতাবুল ঈমান, হা/ ২৩৮)

৪) আল্লাহ্ তা‘আলা যে আরশে আযীমে সমুন্নত মিরাজের ঘটনা তার সুস্পষ্ট প্রমাণ। কারণ আল্লাহ্ তা‘আলা আরশে এবং আসমানে না হলে উপরের দিকে মিরাজ হওয়ার কোন অর্থ হয় না।

৫) সকল ইবাদতের মধ্যে সলাত হচ্ছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। কারণ আল্লাহ্ তা‘আলা অন্যান্য ইবাদত যমীনে ফরয করেছেন। আর সলাত ফরজ করেছেন তাঁর প্রিয় বন্ধুকে কাছে ডেকে নিয়ে সাত আসমানের উপরে। এতে সলাতের গুরুত্বের কথাটি সহজেই অনুধাবন করা যায়।

৬) সলাত পরিত্যাগ করা কঠিন অপরাধ। তাই বেসলাতীর শাস্তিও অত্যন্ত কঠোর।

৭) ব্যভিচার একটি ঘৃণিত কাজ। এর শাস্তিও অত্যন্ত নিকৃষ্ট।

৮) সুদখোরের ভয়াবহ পরিণতি।



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Be alert before spamming comments.

নবীনতর পূর্বতন

Sponsored

Responsive Ad