লাইলাতুল মেরাজ : বায়তুল মুকাদ্দাস -সিদরাতুল মুন্তাহা থেকে প্রবাহিত নদীসমূহ
বায়তুল মুকাদ্দাস
হাবিবে খোদা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মসজিদে হারাম থেকে বোরাক যোগে বায়তুল মুকাদ্দাস পৌঁছেন এবং বোরাককে মসজিদের দরওয়াজার থাম্বার সাথে বেঁধে রাখেন, বর্তমানে যাকে বাবে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলা হয়ে থাকে। এরপর মসজিদে প্রবেশ করে দুই রাকাত নামায আদায় করেন। খুব সম্ভব এ দু’রাকাত নামায তাহিয়্যাতুল মসজিদ এর নামায ছিল। এ স্থানে ফেরেশতাগণ উপস্থিত হন এবং হযরত আদম আলাইহিস সালাম হতে হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম পর্যন্ত সকল নবীগণ উপস্থিত হন। তাঁরা আল্লাহতা’য়ালার হাম্দ ও নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সালাত ও সালাম পেশ করেন। এমতাবস্থায় সকলেই হাবিবে খোদার শ্রেষ্ঠত্বের স্বীকৃতি দান করেন। তারপর আযান ও একামতের মাধ্যমে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইমামতিতে সকল আম্বিয়া ও ফেরেশতাগণ জামাত সহকারে নামায আদায় করেন। উলামায়ে কেরামদের মধ্যে মতবিরোধ রয়েছে, এ নামায নফল ছিল নাকি ফরয। যদি ফরয হয়ে থাকে ইশার নামায অথবা ফজরের নামায। হাদিসশরীফের পূর্বাপর ধারা হতে স্পষ্টত বুঝা যায় যে, বায়তুল মুকাদ্দাস পর্যন্ত শুভাগমন করা ঊর্ধ্বগগনে গমনের পূর্বে ছিল, তা হলে এ নামায হবে ইশার নামায। আর যদি এ ঘটনা ঊর্ধ্বজগত হতে অবতরণের পর হয়, তাহলে হবে ফজরের নামায। কেউ কেউ এ মতের উপরই বেশি জোর দিয়েছেন। কেননা রাসূলে আনওয়ার সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন আল্লাহর পক্ষ থেকে সকল শ্রেষ্ঠত্ব ও বরকতসমূহ নিয়ে অবতরণ করলেন, তখন সকল আম্বিয়া আলাইহিমুস সালাম এর উপর হাবিবে খোদার শ্রেষ্ঠত্ব ও মর্যাদাকে প্রকাশ করার জন্য এ নামায আদায় করেছিলেন। শায়খ আব্দুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভী আলাইহির রহমত শায়খ ইমাদুদ্দীন ইবনে কাছির যিনি হাদিস ও তাফসিরের শ্রেষ্ঠ পন্ডিতগণের একজন খ্যাতনামা পন্ডিত ছিলেন, তার রেফারেন্স দিয়ে এ মাসআলার এভাবে সমাধান দিয়েছেন যে, রাসূলে আনওয়ার সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ঊর্ধ্বাকাশে গমনের পূর্বে এবং পরে উভয় অবস্থায় নবীগণের সাথে নামায আদায় করেছেন। (মাদারিজুন নবুয়ত) রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন মসজিদ হতে বাইরে তাশরিফ আনয়ন করলেন, তখন জিব্রাইল আলাইহিস সালাম এক পেয়ালা শরাব ও এক পেয়ালা দুধের হাদিয়া পেশ করে আরজ করলেন- যে পিয়ালা ইচ্ছা মাহবুবে খোদা পান করতে পারেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দুধের পিয়ালাকে পছন্দ করলে, জিব্রাইল আলাইহিস সালাম বললেন- আপনি ফিতরাতকে গ্রহণ করেছেন। এ স্থানে ইসলাম ও উহার উপর প্রতিষ্টিত থাকাকে ফিতরাতের মর্ম গ্রহণ করা হয়েছে। অর্থাৎ ছরকারে কায়েনাত আলাইহিস সালাম ইসলামের নিদর্শন ও দৃঢ় প্রত্যয়কেই গ্রহণ করেছেন। দুগ্ধপান ইসলামের নিদর্শন। হযরত ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে হাদিস বর্ণিত আছে যে, দু’পিয়ালা আনয়ন করা হয়, একটি দুধের এবং অপরটি মধুর পেয়ালা। এক রেওয়ায়েতে রয়েছে, তিন পিয়ালা আনয়ন করা হয়, দুধ-পানি ও শরাবের পিয়ালা। এ রেওয়ায়েতে মধুর উল্লেখ নেই। যা হোক নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দুধ গ্রহণ করা পছন্দ করেছেন। সিদরাতুল মুন্তাহায় পৌঁছার পরই এ সকল পেয়ালা আনয়ন করা হয়। হাফিজ ইমাদুদ্দীন ইবনে কাছির আলাইহির রহমত এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন।
(মাদারিজুন নবুয়ত)
শায়খ আব্দুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভী আলাইহির রহমত ‘মাদারিজুন নবুয়ত’ কিতাবে উল্লেখ করেন- বর্ণিত আছে, আল্লাহতায়ালা হযরত ইব্রাহিম, হযরত মুসা, হযরত দাউদ, হযরত সুলায়মান এবং হযরত ঈসা আলাইহিমুস সালাম প্রমূখ নবীগণকে যে সকল শ্রেষ্ঠ কারামত ও অলৌকিকত্বসমূহ দান করেছিলেন তাঁরা সকলে এর শোকরিয়া আদায় করার জন্য আল্লাহ আজ্জা ওয়া জাল্লাহর দরবারে তাঁরই প্রশংসায় বিমূঢ় হয়ে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছিলেন, এ ক্ষমতা আল্লাহপাকই তাদেরকে দান করেছিলেন। আল্লাহর হাবিব তখন আল্লাহর নি’য়ামতের শোকরিয়া আদায় করতে গিয়ে বলেছেন-
الحمد لله الذى ارسلنى رحمة للعلمين بشيرا ونذيرا للناس اجمعين وانزل على الفرقان فيه تبيان كل شئ وجعل امتى وسطا وجعل امتى هم الاولون وهم الاخرون وشرح لى صدرى ووضع عنى وزرى ورفع لى ذكرى وجعلنى فاتحا وخاتما-
অনুবাদ: সমস্ত প্রশংসা একমাত্র আল্লাহতা’য়ালার জন্যে যিনি আমাকে সমগ্র সৃষ্টির জন্য রহমত এবং সকল মানুষের জন্য সুসংবাদ দানকারী ও ভয় প্রদর্শনকারী করে প্রেরণ করেছেন। আর আমার উপর এমন মহা-বিজ্ঞানময় কুরআন অবতরণ করেছেন যার মধ্যে সকল বস্তুর বর্ণনা উজ্জ্বলতম রূপে করা হয়েছে। আমার উম্মতগণকে মধ্যমপন্থী উম্মত বানানো হয়েছে। আর আমার উম্মতগণকে পরিগণিত করিয়েছেন যে, উহারাই প্রথম এবং উহারাই শেষ হবে এবং আমার জন্য আমার বক্ষ মোবারককে উম্মুক্ত করে দিয়েছেন এবং আমার বোঝাকে বিদূরিত করে দিয়েছেন এবং আমার জন্য আমার জিকিরকে সমুন্নত করে দিয়েছেন এবং আমাকে বিজয়ী বানিয়েছেন এবং আমাকে সর্বশেষ নবী উপাধীতে ভূষিত করেছেন অর্থাৎ নবুওয়তের ধারায় আমিই সর্বশেষ নবী। (আমার পরে কিয়ামত পর্যন্ত আর কোন নবী নেই)। এ বর্ণনাদানের পর হযরত ইব্রাহিম আলাইহিস সালাম বললেন-
بهذا افضلكم محمد
হে নবী! এ কারণে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে তোমাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন।
সিদরাতুল মুন্তাহা
সাত আসমানের বিস্ময়কর ও বিরল বিষয়াবলী এবং আল্লাহ আজ্জা ওয়া জাল্লাহর নিদর্শনসমূহ প্রত্যক্ষ করে হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সিদরাতুল মুন্তাহায় পৌঁছেন। সিদরাতুল মুন্তাহা হচ্ছে একটি কুলবৃক্ষ এবং সৃষ্টির জ্ঞানের শেষ প্রান্ত। তাফসিরে রুহুল মা’য়ানী’ নয় নম্বর খ- ২৭ পারা ৫০ পৃষ্ঠায় উল্লেখ রয়েছে-
(عند سدرة المنتهى) هى شجرة نيق عن يمين العرش فى السماء السابعة على المشهور وفى حديث اخرجه احمد ومسلم والترمذى وغيرهم فى السماء السادسة نبقها كقلال هجر واوراقها مثل اذاب الفيلة يسير الراكب فى ظلها سبعين عاما لايقطعها-
ভাবার্থ: ‘সিদরাতুল মুন্তাহা’ হলো একটি কুলবৃক্ষ। আরশের বামদিকে সপ্ত আকাশে অবস্থিত। এ অভিমতই হলো প্রসিদ্ধ। ইমাম আহমদ, ইমাম মুসলিম এবং ইমাম তিরমিজি প্রমূখ হাদিস বিশারদগণ রেওয়ায়েত করেছেন, সিদরাতুল মুন্তাহা হলো ষষ্ঠ আকাশে অবস্থিত। এ গাছের পাতা হলো হাতির কর্ণের মত। এ পাতার ছায়াতলে একজন আরোহী ৭০ বৎসর পর্যন্ত চলতে থাকলেও এর ছায়ার পরিধি শেষ হবে না।’ উপরোক্ত উভয় রেওয়ায়েতের মধ্যে এভাবে তাতবিক বা সামঞ্জ্য স্থাপন করা সম্ভব যে, ‘সিদরাতুল মুন্তাহা’ এর মূলভিত্তি হলো সপ্তম আকাশে এবং উহার ডাল-পালা ষষ্ঠ আকাশে। উক্ত বৃক্ষের তিন প্রকারের গুণ রয়েছে। এক, উহার ছায়া অনেক দীর্ঘ। দ্বিতীয় হলো উহার স্বাধ বড় মজার। তৃতীয় হলো, উহার গন্ধ বড় সুমধুর। আল্লামা সৈয়দ মাহমুদ আলুছি আল বাগদাদী আলাইহির রহমত (ওফাত ১২৭০ হিজরি) اذ يغشى السدرة ما يغشى এ আয়াতে কারিমার তাফসিরে তদীয় روح المعانى ‘রুহুল মায়ানী’ নামক কিতাবের নবম জিল্দ ২৭ পারা ৫১ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেন-
واخرج عبد بن حميد عن سلمة قال: استأذنت الملائكة الرب تبارك وتعالى ان ينظروا الى النبى صلى الله عليه وسلم فأذن لهم فغشيت الملائكة السدرة لينظروا اليه عليه الصلوة والسلام وفى حديث رأيت على كل ورقة من ورقها ملكا قائما يسبح الله تعالى-
ভাবার্থ: হযরত আবদ ইবনে হামিদ হযরত সালমা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেন, ফেরেশতাগণ আল্লাহতা’য়ালার শাহানশাহী দরবারে হাবিবে খোদা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দেখার অনুমতি প্রার্থনা করলে, আল্লাহতা’য়ালা তাঁদেরকে অনুমতি প্রদান করলেন। অতঃপর সকল ফেরেশতাগণ সিদরাতুল মুন্তাহায় অবস্থান নিয়ে হাবিবে খোদার দর্শনের জন্য সিদরাতুল মুন্তাহাকে আচ্ছাদিত করে নূরনবীর দিদারে ধন্য হলেন। অন্য এক হাদিসে উল্লেখ রয়েছে- হাবিবে খোদা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, আমি সিদরা বা কুলবৃক্ষের প্রত্যেক পাতায় পাতায় একেকজন ফেরেশতা দেখেছি, যারা দাঁড়িয়ে ‘সুবহানাল্লাহ!সুবহানাল্লাহ!পাঠ করছেন।
সিদরাতুল মুন্তাহা থেকে প্রবাহিত নদীসমূহ
সিদরাতুল মুন্তাহা হতে চারটি নদী প্রবাহিত হয়েছে- যথা দুইটি বাইরে এবং দুইটি ভিতরে। ভিতরের দুটি জান্নাতে প্রবাহিত আর বাইরের দুইটিকে নীল ও ফোরাত নদী বলা হয়ে থাকে। হযরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু এর হাদিস হতে জানা যায় যে, এ চারটি নদীই জান্নাত হতে প্রবাহিত হয়ে থাকে। নীল, ফোরাত, সায়হান ও জায়হান।
হাউজে কাউছার
ইবনে আবি হাতিম হযরত আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু কর্তৃক বর্ণিত এক হাদিসের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছেন যে, রাসূলে আনওয়ার সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন সপ্তম আকাশ হতে বের হয়ে আসেন, তখন এক নদী প্রত্যক্ষ করেন। যা ইয়াকুত ও যবরজাদ পাথরের টুকরার উপর প্রবাহমান। আর উহার পিয়ালা স্বর্ণ, রৌপ্য, ইয়াকুত, মুক্তা, এবং যবরজাদের প্রস্তুতকৃত। আর উহার পানি দুধের চেয়েও অধিক সাদা এবং মধুর চেয়েও অধিক মিষ্টি। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন- হে জিব্রাইল এ গুলি কি? জিব্রাইল আলাইহিস সালাম আরজ করলেন- ইহা হলো حوض كوثر ‘হাউজে কাউছার’ এ মহান নিয়ামত আল্লাহতা’য়ালা আপনাকে দান করেছেন।
নহরে রহমত
হযরত আবু সাঈদ খুদরি রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হাদিস শরীফে রয়েছে- জান্নাতে যে নদী প্রবাহিত হয়েছে, যাকে سلسبيل ‘সালসাবিল’ নামে অভিহিত করা হয়ে থাকে। উহা হতে দুইটি নদী বের হয়েছে। একটির নাম كوثر ‘কাউছার’ দ্বিতীয়টির নাম نهر رحمت ‘নহরে রহমত’। ইহা সেই রহমতের দরিয়া, যখন শাফায়াতের উসিলায় পাপী ব্যক্তি, পাপের শাস্তি ভোগ করার পর দোযখে জ্বলে পুড়ে কাল অবস্থায় বের হয়ে আসবে, তখন সেই দরিয়ায় অবগাহন করবে এবং তৎক্ষণাৎ সজিব হয়ে যাবে।