স্বামী যদি স্ত্রীর চাহিদা পূরণ করতে ব্যর্থ হয় তাহলে তার হুকুম কী?
জিজ্ঞাসা–১: আসসালামু আলাইকুম। আমি জানতে চাই, শুনেছি , ইসলামে একজন স্ত্রী যদি স্বামীর বৈধ কোন কথা না শুনে সেজন্য তার শাস্তির বর্ণনায় বিভিন্নভাবে হুশিয়ারি করা আছে। স্বামী যদি স্ত্রীকে ঘনিষ্ঠতার জন্য আহ্বান করে আর স্ত্রী সায় না দিলে সারারাত ফেরেশতাগণ লানত বর্ষণ করেন ঐ নারীকে এবং স্বামীর প্রতিও নির্দেশ আছে যেকোন অন্যায়ে স্ত্রীকে প্রথমে বুঝাতে, এতে না হলে তার সাথে শয্যা ত্যাগ করতে, এতে না হলে মৃদু প্রহার করতে এতেও না হলে স্ত্রী ত্যাগের কথাও বৈধ আছে। একজন স্ত্রীর বৈধ কথা শুনাটাও তো স্বামীর কর্তব্য তাই নয় কি?
নারীকে শুধু ধৈর্যের কথাই বলা হয় এবং ধৈর্যের ফলাফল সম্পর্কে সুসংবাদ দেয়া হয়। তাহলে পুরুষকেও তো এভাবে ধৈর্যের জন্য জোর দেয়া উচিত স্ত্রীর প্রতি সেটা কেন নয়? একজন স্বামী তার স্ত্রীর সাথে ৩/৪ মাসে একবার ঘনিষ্ঠ হয় যদি তার নিজের ইচ্ছে হয় সেক্ষেত্রে। এজন্য তাকে অনেক বুঝানো হয়েছে ইঙ্গিতে। জোর করে ডাক্তারের কাছে একাধিকবার নেয়া হলেও সে ঔষধটাও খান না।
এতে কাজ না হওয়ায় সরাসরিভাবে এ ব্যাপারে কথা বলে বুঝানো হয়েছে যে, ‘এভাবে চললে আমিও তো মানুষ, আমারও তো চাহিদা বা সন্তুস্টির প্রয়োজন সৃস্টিগতভাবেই আছে। এজন্য আমি কোনভাবে কোন গুনাহে লিপ্ত হলে সেটার জন্য তুমি দায়ী থাকবে।
’ আর এভাবে শান্তভাবে যুক্তি দিয়ে বোঝানোর পরও সে যদি বলে, যা মন চায় করো গিয়ে। অত:পর দুজনের মধ্যে মনোমালিন্য ঝগড়াঝাটি… তারপরও সেই স্বামী যদি তার মন মতোই চলে তাহলে এক্ষেত্রে ইসলামে ঐ নারীর জন্য কি হুকুম? স্বামী খুব সামান্যতেই সংসারের পরিস্থিতি পরিবেশ বাজে করে রাখে এমনকি সন্তানদের জন্যও সামান্যতম উৎকন্ঠা বোধ করে না।
ইসলামিক বিভিন্ন দোয়া দরুদ দিয়ে অনেক চেস্টা করেছি কোন পরিবর্তন নেই। মূল প্রশ্ন হচ্ছে, একজন স্ত্রীরও তো স্বাভাবিক চাহিদা থাকে। এভাবে যে স্ত্রীর হক প্রতিনিয়ত খুন করা হচ্ছে সেক্ষেত্রে ঐ স্ত্রীর জন্য কি নির্দেশ ইসলামে?–সাদিয়া
জবাব: وعليكم السلام ورحمة الله وبركاته
এক- স্বামী স্ত্রীর চাহিদা পূরণ করাও সদাচারণের অন্তর্ভুক্ত। এটা স্ত্রী হিসেবে তার অধিকার। এই অধিকার পূরণ করা সক্ষম স্বামীর ওপর ওয়াজিব। কেননা, আল্লাহ তাআলা বলেছেন, وَعَاشِرُوهُنَّ بِالْمَعْرُوفِ ‘আর তোমরা স্ত্রীদের সঙ্গে সদাচারণ কর, (সূরা নিসা ১৯)
আল মাউসুয়া’তুল ফিকহিয়্যা (৩০/১২৭)-তে এসেছে,
من حقّ الزّوجة على زوجها أن يقوم بإعفافها ، وذلك بأن يطأها ، وقد ذهب جمهور الفقهاء — الحنفيّة والمالكيّة والحنابلة — إلى أنّه يجب على الزّوج أن يطأ زوجته
‘স্বামীর ওপর স্ত্রীর অধিকারের মধ্যে অন্যতম হল, স্বামী স্ত্রীর সঙ্গে সঙ্গমের মাধ্যমে তার পবিত্র জীবন যাপনের প্রতি যত্নশীল হবে। হানাফি, মালেকি ও হাম্বলি মাযহাবের অধিকাংশ ফকিহর মতে স্ত্রীর সঙ্গে সঙ্গমে লিপ্ত হওয়া স্বামীর জন্য ওয়াজিব।’
সঙ্গম কত দিন পর হতে হবে–এব্যাপারে ফকিহগণের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে। শাইখুল ইসলাম ইবন তাইমিয়া রহ. বলেন,
يجب على الرجل أن يطأ زوجته بالمعروف ، وهو من أوكد حقها عليه ، أعظم من إطعامها ، والوطء الواجب قيل : إنه واجب في كل أربعة أشهر مرة ، وقيل : بقدر حاجتها وقدرته ، كما يطعمها بقدر حاجتها وقدرته ، وهذا أصح القولين
‘স্ত্রীর সঙ্গে ভালোভাবে সঙ্গমে লিপ্ত হওয়া ওয়াজিব। এটা স্ত্রীর গুরুত্বপূর্ণ অধিকার এবং ভরণপোষণের অন্যতম অংশ। কেউ কেউ বলেছেন, চার মাসে একবার ওয়াজিব। কারো কারো মতে এক্ষেত্রে ভরণপোষণের অন্যান্য বিষয়ের মত স্ত্রীর প্রয়োজন ও স্বামীর সক্ষমতাই মূল বিবেচ্য বিষয়। আর এটাই বিশুদ্ধ মত।’ (মাজমুউল ফাতাওয়া ৩২/২৭১)
দুই- প্রিয় বোন, আপনার স্বামী আপনার এই অধিকার আদায়ে অক্ষম তার শারীরিক কিংবা মানসিক সমস্যার কারণে; যেমনটি আপনার কথা থেকে বুঝা যাচ্ছে। এক্ষেত্রে আপনার প্রতি আমাদের সুধারণা হল এই যে, একজন নেককার স্ত্রী হিসেবে তার এই পরিস্থিতিতে আপনি তার সঙ্গ দিবেন। তাকে যেকোনোভাবে চিকিৎসকের শরণাপন্ন করবেন। দোয়া ও নামাযের মাধ্যমে আল্লাহর কাছে সাহায্য চাইবেন।
আর যদি তার এই অনীহার কারণ হয়, আপনার প্রতি আগ্রহ অনুভব না করা। তাহলে তার জন্য সাজসজ্জা করে, তার সঙ্গে ভালবাসাপূর্ণ নিত্যনতুন রোমান্টিক আচরণ করে তাকে আপনার প্রতি আগ্রহী করে তোলার চেষ্টা করতে পারেন। হতে পারে, আল্লাহ তাআলা এর মাধ্যমে আপনাকে সফল করবেন। যদি আল্লাহর রহমত সঙ্গী হয় তাহলে হতে পারে আপনি তাকে মানসিক শান্তি দিলে তিনি আপনাকে মানসিক শান্তি দিবেন, শারীরিক সুখও দিবেন।
উল্লেখ্য যে, মানবিক এই চাহিদা পূরণের ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের মধ্যে সৃষ্টিগতভাবেই ব্যবধান আছে। নারী তার ঋতুকালীন সময় ও একান্ত অসুস্থতা ছাড়া স্বামীর চাহিদা যেকোন সময়ে পূরণ করতে পারে। এ ক্ষেত্রে তার উত্তেজনা থাকা জরুরি নয়। পক্ষান্তরে পুরুষ তা পারে না। পুরুষ তার স্ত্রীর এই চাহিদা পূরণ করতে হলে উত্তেজনা ও সক্ষমতার প্রয়োজন হয়। আগ্রহের দরকার হয়। এজন্য হাদিস শরিফে সঙ্গমে অস্বীকারকারী স্ত্রীর ব্যাপারে ‘ধমক’ এসেছে। পক্ষান্তরে স্বামীর ব্যাপারে তা আসে নি। কেননা, আল্লাহ তাআলার নীতি হল, لَا يُكَلِّفُ اللَّهُ نَفْسًا إِلَّا وُسْعَهَا ‘আল্লাহ কাউকে তার সাধ্যাতীত কোন কাজের ভার দেন না।’ (সূরা বাকারা ২৮৬)
তিন- আপনি বলেছেন, আপনার গুনাহয় জড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা আছে। এক্ষেত্রে আপনার প্রতি আমাদের উপদেশ হল, আল্লাহকে ভয় করুন। আল্লাহ বলেছেন,
وَلَا تَقْرَبُوا الزِّنَا ۖ إِنَّهُ كَانَ فَاحِشَةً وَسَاءَ سَبِيلًا
আর ব্যভিচারের কাছেও যেয়ো না। নিশ্চয় এটা অশ্লীল কাজ এবং মন্দ পথ। (সুরা বনী-ইসরাঈল ৩২)
তাই আমরা আপনার প্রতি এই সুধারণা রাখব যে, আপনি এমনটি করবেন না। বরং আপনি আপনার স্বামীকে সুস্থ করে তোলার ব্যাপারে সচেষ্ট হবেন। তিনি যখন অসুস্থ; আপনাকে তো একটু কষ্ট করতে হবে, ধৈর্যের পরিচয় দিতে হবে। সর্বোপরি আল্লাহর কাছে সাহায্য চাইতে হবে।
আর যদি আপনি মনে করেন, আপনি যথেষ্ট সবর করেছেন। আর পারছেন না বা পারবেন না। কিংবা যদি আপনি আপনার স্বামীর ব্যাপারে সম্পূর্ণ নিরাশ হন তাহলে আপনার স্বামীর উচিত, উত্তম পদ্ধতিতে তালাকের মাধ্যমে আপনাকে মুক্ত করে দেয়া। যদি তিনি তা না করেন তাহলে ইসলাম আপনাকে এই অধিকার দিয়েছে যে, আপনি তার কাছে তালাকের দাবী করতে পারেন। তখন এ দাবী করাটা আপনার জন্য অন্যায় হবে না।
আমরা দোয়া করি, আল্লাহ যেন আপনাদের জীবনকে সুন্দর করে দেন। নিশ্চয় তিনি ক্ষমতাবান।
والله اعلم بالصواب
উত্তর দিয়েছেন
মাওলানা উমায়ের কোব্বাদী