ইসলামে সফর মাসের গুরুত্ব ও তাৎপর্য

ইসলামে সফর মাসের গুরুত্ব ও তাৎপর্য



মানুষের জীবনে সময় অত্যন্ত মূল্যবান। মহাকালের অন্তহীন ও চলমান সময়ের ক্ষুদ্র অংশ হলো মানব জীবন। সময়ের সাথেই মানুষ অতিবাহিত করে নিজের জীবনের শৈশব, কৈশোর, যৌবন, প্রৌঢ়ত্ব ও বার্ধক্যের নানা পর্যায়। একে একে অতিবাহিত হয়ে যায় দিন-রাত, সপ্তাহ, মাস ও বছর। দিন-রাতের আবর্তন, সপ্তাহ, মাস, বছর এগুলোকে হিসাব করেই মানুষ নিজেদের দৈনন্দিন কাজ সম্পাদন করে থাকে। মূলত চন্দ্র-সূর্যের কারণে দিবা-রাত্রির আবর্তন হয়ে থাকে। আল্লাহ তায়ালা বলেন- তিনিই সূর্যকে তেজস্কর ও চন্দ্রকে জ্যোতির্ময় করেছেন এবং তার জন্য নির্ধারণ করে দিয়েছেন বিভিন্ন মনজিল। যাতে তোমরা বৎসর গণনা ও সময়ের হিসাব জানতে পার। সূরা ইউনুস-৫] মানুষ চন্দ্র ও সূর্যকে কেন্দ্র করে সময়মতো সালাত, রোজা, হজ-যাকাত সম্পন্ন করেন। 

মানুষের হিসাবের জন্য আল্লাহ তায়ালা বারোটি মাস নির্ধারিত করেছেন। চন্দ্র মাসের দ্বিতীয় মাস হলো সফর। সফর শব্দের অর্থ হলো হলুদ বর্ণ, শূন্য, রিক্ত, ফ্যাকাশে, রক্তশূণ্য ইত্যাদি। এর পূর্বের মাস ছিল মহররম। মহররম মাস হলো চারটি সম্মানিত মাসের মধ্যে অন্যতম। এতে যুদ্ধ-বিগ্রহ নিষিদ্ধ ছিল। তাই সফর মাস আসলে আরবের লোকেরা যুদ্ধের জন্য ঘর থেকে বের হয়ে পড়ত। তাদের ঘরগুলো জন-মানব শূন্য হয়ে পড়ে থাকত বলে এ মাসকে সফর বলা হয়। আরবরা এমাসকে দুঃখ ও বেদনার মাস মনে করত। এমনকি এমাসের চাঁদ উদিত হলে তারা নতুন চাঁদকেও দেখতে চায়তো না। মাস এবং দিন আল্লাহ তায়ালারই সৃষ্টি। তাই সৃষ্টির সকল রাত-দিনই নেক আমলের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। একজন মানুষ শরিয়তের বিধান মেনে প্রতি মুহূর্তেই নেকআমল করে যেতে পারে। আল্লাহর সৃষ্ট কোনো দিন বা মাস অলক্ষণ ও অমঙ্গলজনক হতে পারেনা। কোন বান্দা ফরজ ইবাদতের পাশাপাশি গভীর রাতে সালাত আদায় করে আল্লাহর কাছে দোয়া করলে এবং অন্যান্য নফল ইবাদত করলে তিনি সকল প্রার্থনা কবুল করেন।

আল্লাহর কাছে কোনো বান্দা গ্রহণযোগ্য হওয়ার জন্য মানদন্ড হলো ঈমান, নেকআমল, সুন্দর চরিত্র, হালাল উপার্জন ইত্যাদি। কোনো দিন ও মাসকে দোষারোপ করা ঈমানদারের কাজ হতে পারে না। রাসূলে পাক (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন, আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, মানুষ সময়কে গালি দিয়ে আমাকে কষ্ট দেয়। অথচ, আমিই সময় (সময়ের স্রষ্টা)। সময়ের নিয়ন্ত্রণ আমার হাতেই। আমি রাত দিনের পরিবর্তন করি। (সহীহ বুখারী-৭৪৯১)।

উম্মাহাতুল মুমিনীন হযরত উম্মে সালামা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলেন, একদা প্রিয় নবি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ঘুম থেকে জাগ্রত হয়ে বললেন, সুবহানাল্লাহ! কত চমৎকার এ রাত। এতে কত বিপদ আপতিত হয়, আর এতে কতই রহমতের ধনভান্ডার খুলে দেওয়া হয়! (সহীহ বুখারী-১১৬)

রাসূলে পাক (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) প্রতিদিন সকালবেলা উম্মতের জন্য দোয়া করে বলতেন, “আল্লাহুম্মা বারিক লিউম্মাতি ফি বুকুরিহা”। অর্থ- হে আল্লাহ! আমার উম্মতের জন্য সকালের কাজে বরকত দিন। (তিরমিযী)

অনেক লোক আছে যারা সফর মাসকে কুলক্ষণ বা অলক্ষ্মী মনে করে। প্রকৃত পক্ষে দিন, সপ্তাহ, মাস বছর এগুলো আল্লাহর ইচ্ছাই আবর্তিত হয়। এ মাসের দিন রাতগুলো অন্যান্য মাস, দিন ও রাতের মতোই। এগুলির কোন টিকে কুলক্ষণের কারণ মনে করা অন্যায়। আল্লাহ তায়ালা বলেন, যারা অনুসন্ধান প্রিয় অথবা কৃতজ্ঞতা প্রকাশের ইচ্ছা করে তাদের জন্য তিনি রাত্রি ও দিবস সৃষ্টি করেছেন পরিবর্তনশীলরূপে। (সূরা ফোরকান-৬২)

হযরত আনাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, সংক্রামক ব্যাধি এবং অলক্ষ্মী-কুলক্ষণ বলতে কিছুই নেই। তবে ‘ফাল’ আসা পছন্দনীয়। সাহবায়ে কেরাম জিজ্ঞাসা করলেন ‘ফাল’ কী? উত্তরে তিনি বলেন, এটা উত্তম ও পবিত্র কথা বা সৌভাগ্যের চিন্তা করা। (বুখারী, মুসলিম)

ঐতিহাসিক হুদায়বিয়ার সন্ধি করার সময় কুরাইশদের পক্ষ থেকে বিভিন্ন ব্যক্তির মাধ্যমে নানা প্রস্তাব পাঠানো হচ্ছিল। কিন্তু উভয় পক্ষের মধ্যে সমঝোতা হচ্ছিল না। উরওয়া ইবনে মাসউদ, জুলাইস ইবনে আলকামা বুনানী, মিকরাজ ইবনে হাফস প্রমুখ কুরাইশ নেতার প্রচেষ্টা ব্যর্থ হলে এক পর্যায়ে কুরাইশদের পক্ষ থেকে সুহায়ল ইবনে আমর উপস্থিত হলে নবিজী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাকে দেখে বললেন, “নিশ্চয় তোমাদের কাজ সহজ হয়ে গেল”। কেননা “সুহায়ল” শব্দের অর্থ হলো সহজ। নবিজী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তার নামের দিকে লক্ষ করে ভালো লক্ষণ সাব্যস্ত করলেন। বাস্তবে হয়েও ছিল তাই। (যারক্বানি, খন্ড-২, পৃ:১৯৪)

বনি ইসরাইল কোনো ভালো কিছু দেখলে তা নিজেদের বলে দাবি করত আর অকল্যাণ কিছু দেখলে তা হযরত মুসা আলায়হিস্ সালামের দিকে সম্পৃক্ত। আল্লাহ তায়ালা বলেন- অতঃপর যখন শুভদিন ফিরে আসে, তখন তারা বলতে আরম্ভ করে যে, এটাই আমাদের জন্য উপযোগী। আর যদি অকল্যাণ এসে উপস্থিত হয় তবে তাতে হযরত মুসা এবং তার সঙ্গীদের অলক্ষণ বলে অভিহিত করতো। শুনে রাখো তাদের অলক্ষণ যে, আল্লাহরই ইলমে রয়েছে, অথচ এরা জানে না। (সূরা আরাফ-১৩১)

আল্লাহ তায়ালা আরো বলেন- রাসূলগণ বললেন, তোমাদের অকল্যাণ তোমাদের সাথেই। (সূরা ইয়াসীন-১৯)

তাই ইসলামি বিধানমতে এ মাসে নেতিবাচক কোনো কিছুর অস্তিত্ব নেই। সেই আদিকাল থেকেই আরবের লোকেরা এ মাসকে বলে আসত ‘সাফারুল মুসাফফর’ এর অর্থ হলো বিবর্ণ হওয়া বা চেহারা ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া। ইসলামি বিশ্বাস মতে এ মাসকে বলা হয়ে থাকে ‘আস সাফারুল মুজাফফর’, ‘সফরুল খায়র’। অর্থ সাফল্যের মাস বা কল্যাণের মাস।

ইসলামপূর্ব আরবে মনে করা হতো এ মাসে অনেক রোগ-ব্যাধি অবতীর্ণ হয়। এজন্য তারা এ মাসে কোন শুভ কাজ, বিবাহ, ঘর তৈরি করা থেকে বিরত থাকত। এ ধারণা সঠিক নয়। কারণ রোগ-ব্যাধির সাথে কোন মাস বছর নির্ধারিত নয়। আল্লাহ তায়ালা বলেন, পৃথিবীতে এবং ব্যক্তিগতভাবে তোমাদের উপর যে বিপদাপদ আসে, তা সবই কিতাবে (লওহে মাহফুজে) জগৎ সৃষ্টির পূর্বেই লিপিবদ্ধ আছে। নিশ্চয় এটা আল্লাহর পক্ষে সহজ। (সূরা আল হাদীদ-২২)

হযরত আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলে পাক (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এরশাদ করেছেন- কোনো মুমিন নারী কিংবা পুরুষের উপর এবং সম্পদ ও সন্তান-সন্ততির উপর যখন কোনো বিপদাপদ আপতিত হয়, তখন তা দ্বারা আল্লাহ তায়ালা তার গুনাহ মাফ করে দেন। তৎকালীন আরবের জাহেলিয়া যুগের ঐ অবস্থা দেখে প্রিয় নবি রাহমাতুল্লিল আলামীন (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ঘোষণা দিলেন, রোগ লেগে যাওয়া, কুলক্ষণ, পেঁচা ও সফর মাসের অশুভত্বের কোনো বাস্তবতা নেই। (সহীহ বুখারী-৫৭৫৭, ৫৭৭০)

হযরত আনাস বিন মালিক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রাসূলে পাক (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, ইসলামে সংক্রামক ব্যাধি আর অশুভ আলামত বলতে কিছুই নেই। (সহীহ বুখারী-৫৭৭৬)

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, যে অশুভ আলামত বা দুর্ভাগ্যের ধারণা কোন মানুষকে তার প্রয়োজনীয় দায়িত্ব ও কর্তব্য থেকে দূরে রাখলো সে মূলত শিরক করল। (মুসনাদে আহমদ-২৭/২৫৩৪)

এই মাসের শেষ বুধবারকে বলা হয় আখেরী চাহার শম্বাহ্। কেউ কেউ বলেছেন, রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম সফরের শেষ বুধবারে গোসল করেছিলেন এবং কিছুটা সুস্থতা লাভ করেছিলেন। তবে সেই গোসলটা কোনদিন ছিল তা নিয়ে মতপার্থক্য রয়েছে। আল্লামা ছফিউর রহমান মোবারকপুরী তার “আর রাহীকুল মাখতুম” গ্রন্থে বলেন, আখেরী চাহার শম্বাহ ছিল নবিজী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর ওফাত লাভের পাঁচদিন পূর্বে।

হযরত আয়েশা সিদ্দিকা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলেন, নবিজী যখন আমার ঘরে প্রবেশ করেছিলেন তখন তার অসুস্থতা বৃদ্ধি পেয়েছিল। তখন তিনি বললেন, তোমরা আমার উপর এমন সাত মশকের পানি ঢাল যেগুলোর মুখ এখনো খোলা হয়নি’, যেন আমি সুস্থ হয়ে লোকদেরকে নসিহত করতে পারি। এরপর আমরা তাকে হযরত হাফসা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু এর একটি বড় গামলায় বসালাম। তারপর আমারা উক্ত মশক হতে তাঁর উপর ততক্ষণ পর্যন্ত পানি ঢালতে লাগলাম যতক্ষণ না তিনি তার হাত দ্বারা আমাদেরকে ইশারা করে জানালেন তোমরা তোমাদের কাজ শেষ করেছো। এরপর তিনি মানুষের নিকট গিয়ে তাদের সাথে সালাত আদায় করেন এবং তাদেরকে উদ্দেশ করে খুতবা দেন। (সহীহ বুখারী- ৪৪৪২, ৫৭১৪)

নবিজী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর সুস্থতার খবর পেয়ে সাহাবায়ে কেরাম অত্যন্ত আনন্দিত হন এবং তারা সামর্থ অনুযায়ী দান-সদকা করেন। হযরত আবু বকর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু ৭,০০০ দিনার, হযরত উমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু ৫,০০০ দিনার, হযরত উসমান রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু ১০,০০০ দিনার, হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু ৩,০০০ দিনার, হযরত আব্দুর রহমান ইবনে আওফ ১০০টি উট ও ১০০টি ঘোড়া আল্লাহর রাস্তায় দান করেন।

একাদশ হিজরীর ২৪ সফর থেকে নবিজী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর রোগ প্রবল হতে থাকে। ইতোপূর্বে বিদায় হজের ভাষণে তিনি নিজের ইহকালীন সফর সমাপ্ত করার ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। মুসাফির যেভাবে দূরবর্তী সফরে বের হওয়ার পূর্বে সকল কিছু গুটিয়ে নেন তদ্রুপ নবিজী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর জীবনেও আল্লাহর সান্নিধ্যে পৌছার প্রস্তুতি লক্ষ করা যায়। যেমন ঃ প্রতি রমজান মাসে তিনি দশদিন ই’তেকাফ করতেন। কিন্তু শেষ বছরে তথা দশম হিজরীর রমজান মাসে তিনি বিশ দিন ই’তেকাফ করেছেন। প্রতি রমজানে হযরত জিবরাঈল আলায়হিস্ সালাম একবার পবিত্র কোরআন শরীফের দাওর করতেন;কিন্তু ঐ রমজানে তিনি দু’বার দাওর করেছেন। 

২৯শে সফর সোমবার মতান্তরে ২৮ সফর বুধবার রাতে তিনি তার গোলাম আবু মোয়াইহিবা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুকে নিয়ে মদিনার কবরস্থান জান্নাতুল বাক্বী’তে গিয়ে কবর জিয়ারত করেন। নবিজী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর আযাদকৃত গোলাম আবু মোয়াইহিবা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন একদা মধ্যরাতে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ‘‘আমাকে ডেকে পাঠালেন এবং বললেন, আমাকে বাক্বী’ কবরস্থানে গিয়ে কবরবাসীদের মাগফিরাতের জন্য দোয়া করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তুমি আমার সাথে চলো।’’ তিনি সেখানে পৌছে বললেন, ‘‘হে কবরবাসীরা! তোমাদের উপরে আল্লাহর পক্ষ থেকে রহমত বর্ষিত হোক। 

যে অবস্থায় মানুষ প্রভাব বিস্তার করছে তা থেকে তোমাদের অবস্থা অনেক ভালো। হায়! তোমরা যদি জানতে, আল্লাহ তোমাদেরকে কি কি ফেতনা থেকে মুক্তি দিয়েছেন। যে ফেতনা অন্ধকার রাতে আধাঁরের ন্যায় একের পর এক আসছে আর পূর্বের ফিতনার তুলনায় পরে আসা ফিতনাগুলো অনেক ভয়ংকর।’’ এরপর নবিজী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আমার দিকে ফিরে বললেন,

‘‘হে আবু মোয়াইহিবা! আমাকে পৃথিবীর ধন-ভান্ডার সমূহের চাবি দেওয়া হয়েছে। এরপর চিরস্থায়ী জীবন এবং জান্নাতী হওয়ার মধ্যে একটি বেছে নিতে বলা হয়েছে। আমি আল্লাহর সাক্ষাৎ এবং জান্নাতে যাওয়াকে বেছে নিয়েছি।’’ আমি (বর্ণনাকারী) বললাম, হে আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আমার পিতা-মাতা আপনার জন্য উৎসর্গ। আপনি পৃথিবীর বাদশাহী, চিরস্থায়ী জীবন এবং জান্নাতকে বাছাই করেননি কেন? তিনি বললেন, ‘‘আল্লাহর কসম! কখনো নয়। আমি আমার প্রতিপালকের সাথে সাক্ষাৎ-এরপর জান্নাতে যাওয়াকে নিজের জন্য বাছাই করে নিয়েছি। এরপর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বাক্বী’বাসীদের জন্য মাগফিরাত কামনা করে দোয়া করলেন এবং হুজরা শরীফে ফিরে গেলেন। পরের দিন রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) অসুস্থতা পুনরায় শুরু হলো। সেই অসুস্থ অবস্থায় তার রূহমোবারক কবজ করা হয়। (মুসনাদে আহমদ- ১৬০৪০)

ইসলামের ইতিহাসে এই সফর মাসে অনেকগুলি ঐতিহাসিক ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। দ্বিতীয় হিজরী সনের সফর মাসে ষাটজন মুহাজির বাহিনী সঙ্গে নিয়ে নবিজী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বনি যামরার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য আবওয়ার দিকে রওয়ানা দেন। যুদ্ধের পতাকা ছিল হযরত হামজা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু এর হাতে। কোন যুদ্ধ ছাড়া বনি যামরার সর্দার মাখশী ইবনে আমরের সাথে সন্ধি করে নবিজী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম পনের দিন পর মদিনায় প্রত্যাবর্তন করেন। এখানে যদিও সরাসরি যুদ্ধ হয়নি কিন্তু এটি ছিল মহানবি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) স-শরীরে অংশগ্রহণের মাধ্যমে ইসলামের প্রথম যুদ্ধাভিযান।

তৃতীয় হিজরীর সফর মাসে আরেকটি মর্মান্তিক ঘটনা ঘটেছিল। সেটি হলো বি‘রে মা‘ঊনার ঘটনা। নবীজী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) মুনজির ইবনে আমির সাঈদী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু কে আমির নিযুক্ত করে সত্তর জন ক্বারী বা বিশুদ্ধ তিলাওয়াতকারী সাহাবীগণকে নজদবাসীর উদ্দেশ্যে প্রেরণ করেন। পথিমধ্যে তারা বি‘রে মাঊনার নিকটে যাত্রা বিরতি করেন। এতে আমীর ইবনে তুফাইলের নেতৃত্বে মুসলমানদের উপর নৃশংস ভাবে হামলা চালানো হয়। এই ঘটনায় হযরত আমর ইবনে উমাইয়া রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু ছাড়া প্রায় সকলেই শাহাদাত বরণ করেন। এ ঘটনায় নবিজী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) অত্যন্ত ব্যথিত হন।

মানুষের জীবন অত্যন্ত ক্ষণস্থায়ী। কিন্তু পরকালের জীবন দীর্ঘ ও চিরস্থায়ী। প্রতিটি দিন প্রতিটি মাস ইমানদারের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। প্রকৃত মু’মিন কোন দিন ও মাসকে অবহেলা করে আল্লাহর ইবাদত থেকে দূরে থাকতে পারে না। তাই সফর মাসও ইবাদতের জন্য উপযোগী। এমনিতেই আল্লাহ তায়ালা ইমানদারের প্রত্যেক আমলের সাওয়াবকে কমপক্ষে দশগুণ বৃদ্ধি করেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন, যে ব্যক্তি আল্লাহর কাছে সৎ কাজ নিয়ে হাজির হবে তার জন্য রয়েছে দশগুণ প্রতিফল। আর যে ব্যক্তি অসৎ কাজ নিয়ে আসবে সে ততটুকু প্রতিফল পাবে যতটুকু অপরাধ সে করেছে এবং কারো উপর জুলুম করা হবে না।

(সূরা আনআম-১৬০)

তাই যে ব্যক্তি অন্যান্য মাসের ন্যায় এমাসে বেশি বেশি সালাত আদায় করবে, (বিশেষত তাহাজ্জুদ সালাত) নফল রোজা পালন করবে, দান-সাদকা করবে, যিকির করবে, তার জন্য আল্লাহর দরবারে উত্তম প্রতিদান রয়েছে। রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, ফরজ সালাতে পর সবচাইতে উৎকৃষ্ট সালাত হলো তাহাজ্জুদ সালাত। (সহীহ মুসলিম-১১৬৩)

সূর্যোদয়ের পর ইশরাকের সালাত আদায়ের মাধ্যমে পূর্ণ একটি হজ ও উমরার সাওয়াব পাওয়া যায়। হযরত আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমার অন্তরঙ্গ বন্ধু (রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আমাকে তিনটি বিষয়ে ওসিয়াত করেছেন, যেগুলোকে আমি মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত ছাড়বনা। প্রতি মাসে তিনদিন রোজা রাখা, চাশতের দু’রাকাত সালাত আদায় করা এবং ঘুমানোর পূর্বে বিতর আদায় করা। (সহীহ বুখারী-১১৭৮)

হযরত আবু যর গিফারী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলে পাক (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, যে ব্যক্তি প্রত্যেক মাসের ১৩, ১৪, ১৫ তারিখে রোজা রাখল, সে যেন সারা বছরই রোজা রাখল। (সুনানে ইবনে মাযাহ, পৃ-২২২)

নফল সালাতের মধ্যে আরো ফযিলতপূর্ণ সালাত হলো মাগরিবের সালাতের পর ছয় রাকাত আওয়াবীনের সালাত আদায় করা। রাসূলে পাক (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, যে ব্যক্তি মাগরিবের সালাত আদায় করে ছয় রাকাত সালাত আদায় করবে ঐ সময় সে কোন মন্দ কথা বলবে না, তবে তার সেই সালাত বার বছরের ইবাদতের সমান বলে গণ্য হবে।

মাওলানা মুহাম্মদ মুনিরুল হাছান

লেখক : সিনিয়র শিক্ষক (ইসলাম শিক্ষা) চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুল।

সুত্র: আন্জুমান ট্রাস্ট

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Be alert before spamming comments.

নবীনতর পূর্বতন

Sponsored

Responsive Ad