সিয়াম ও রমযান এর গুরুত্ব ও ফযীলত

 সিয়াম ও রমযান এর গুরুত্ব ও ফযীলত 

রোযা : গুরুত্ব ও ফযীলত


আল্লাহ্ তা'আলা ঈমানদারদের জন্য রমযান মাসের রোযা ফরয করেছেন। আল্লাহ্ তা'আলা বলেন----

یٰۤاَیُّهَا الَّذِیْنَ اٰمَنُوْا كُتِبَ عَلَیْكُمُ الصِّیَامُ كَمَا كُتِبَ عَلَی الَّذِیْنَ مِنْ قَبْلِكُمْ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُوْنَ.

হে ঈমানদারগণ, তোমাদের উপর রোযা ফরয করা হয়েছে, যেভাবে তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর ফরয করা হয়েছিল, যাতে তোমরা মুত্তাকী হতে পার। (সূরা বাকারা : ১৮৩)



এ আয়াতে বলা হচ্ছে--- ক) ঈমানদারদের জন্য রোযা রাখা ফরয। খ) রোযা কেবল এ উম্মতের উপরই ফরয নয়, পূর্ববর্তীদের উপরও ফরয ছিল। গ) রোযা ফরয করার উদ্দেশ্য হল মুমিনগণ যাতে তাকওয়া অর্জন করতে পারে।তো দেখা যাচ্ছে, রোযার মূল উদ্দেশ্যই হচ্ছে তাকওয়া হাছিল করা।

 

রমযানের রোযা : ইসলামের ভিত্তিমূলের একটি:


ইসলামের মৌলিক যে পাঁচটি ভিত্তি, রমযানের রোযা তাঁর অন্যতম। রাসূলুল্লাহ্ (ছাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াছাল্লাম) ইরশাদ করেন----

بُنِيَ الإِسْلاَمُ عَلَى خَمْسٍ: شَهَادَةِ أَنْ لاَ إِلَهَ إِلّا اللهُ وَأَنّ مُحَمّدًا رَسُولُ اللهِ، وَإِقَامِ الصّلاَةِ، وَإِيتَاءِ الزّكَاةِ، وَالحَجِّ، وَصَوْمِ رَمَضَانَ.

ইসলামের ভিত্তি পাঁচটি। ১) এ কথার সাক্ষ্য দেওয়া যে, আল্লাহ্ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই এবং মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াছাল্লাম) আল্লাহর রাসূল। ২) সালাত কায়েম করা। ৩) যাকাত আদায় করা। ৪) হজ্ব পালন করা এবং ৫) রমযানের রোযা রাখা। (সহীহ বুখারী, হাদীস ৮; সহীহ মুসলিম,হাদীস ১৬)


রোযা : গুনাহ মাফের মাধ্যম:


রমযান মাসের রোযা এতটা মহিমান্বিত একটি আমল, যার মাধ্যমে আল্লাহ্ রাব্বুল 'আলামীন বান্দার অতীতের সকল গুনাহ-খাতা ক্ষমা করে দেন।রাসূলুল্লাহ্ (ছাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াছাল্লাম) ইরশাদ করেন---

مَنْ صَامَ رَمَضَانَ، إِيمَانًا وَاحْتِسَابًا، غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدّمَ مِنْ ذَنْبِه.

যে ব্যক্তি ঈমান এবং ইহতিসাব তথা আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস এবং সওয়াবের প্রত্যাশা রেখে রমযান মাসে রোযা রাখবে, তাঁর পূর্বের গুনাহগুলো মাফ করে দেওয়া হবে। (সহীহ বুখারী, হাদীস ৩৮)


তো ঈমান ও ইহতিসাবের উপলব্ধি জাগ্রত রেখে রোযা রাখা অনেক গুরুত্বপূর্ণ একটি আমল এবং বান্দার গুনাহ মাফের একটা মাধ্যম।


আল্লাহ্ তা'আলার নিকট বান্দার রোযা অত্যন্ত প্রিয়। রোযা ও রোযাদারের ব্যাপারে হাদীসে কুদসীতে চমৎকার বিবরণ এসেছে----

قَالَ اللهُ: كُلّ عَمَلِ ابْنِ آدَمَ لَهُ، إِلّا الصِّيَامَ، فَإِنّهُ لِي وَأَنَا أَجْزِي بِهِ، وَالصِّيَامُ جُنّةٌ، وَإِذَا كَانَ يَوْمُ صَوْمِ أَحَدِكُمْ فَلاَ يَرْفُثْ وَلاَ يَصْخَبْ، فَإِنْ سَابّهُ أَحَدٌ أَوْ قَاتَلَهُ، فَلْيَقُلْ إِنِّي امْرُؤٌ صَائِمٌ. وَالّذِي نَفْسُ مُحَمّدٍ بِيَدِهِ، لَخُلُوفُ فَمِ الصّائِمِ أَطْيَبُ عِنْدَ اللهِ مِنْ رِيحِ المِسْكِ. لِلصّائِمِ فَرْحَتَانِ يَفْرَحُهُمَا: إِذَا أَفْطَرَ فَرِحَ، وَإِذَا لَقِيَ رَبّهُ فَرِحَ بِصَوْمِه.

অন্য বর্ণনায় এসেছে----

يَتْرُكُ طَعَامَهُ وَشَرَابَهُ وَشَهْوَتَهُ مِنْ أَجْلِي. الصِّيَامُ لِي، وَأَنَا أَجْزِي بِهِ وَالحَسَنَةُ بِعَشْرِ أَمْثَالِهَا.

(দ্র. সহীহ বুখারী, হাদীস ১৮৯৪, ১৯০৪, ৭৪৯২; সহীহ মুসলিম, হাদীস ১১৫১)


 রোযা ঢাল স্বরূপ :

রোযা নামক এ ঢালকে কীভাবে  অক্ষুণ্য রাখতে হবে; বিদীর্ণ হওয়া থেকে রক্ষা করতে হবে এ বিষয়ে হাদীস শরীফে বলা হয়েছে----

وَإِذَا كَانَ يَوْمُ صَوْمِ أَحَدِكُمْ فَلاَ يَرْفُثْ وَلاَ يَصْخَبْ، فَإِنْ سَابّهُ أَحَدٌ أَوْ قَاتَلَهُ، فَلْيَقُلْ إِنّي امْرُؤٌ صَائِمٌ.

(অনুবাদ :) যখন তোমাদের রোযার দিন আসে তখন তোমরা অশ্লীল কথা ও কাজ থেকে বিরত থাকবে এবং চিৎকার-চেঁচামেচি করবে না। কেউ যদি ঝগড়া-বিবাদে প্রবৃত্ত হয় তাহলে সে (নিজেকে নিবৃত্ত রাখবে এবং) বলবে, আমি রোযাদার। [সহীহ বুখারী, হাদীস ১৮৯৪]


অতএব রোযা কেবল দুই অঙ্গের নয়। হাত-পা, চোখ, কান, মুখ এবং মন মানসসহ শরীরের সকল অঙ্গের ক্ষেত্রেও রোযার আবেদন রক্ষা করা জরুরি। যাতে ঐ দুই নারীর মত না হয়, যারা রোযা অবস্থায় গীবত করেছিল। তখন তাদের ব্যাপারে বলা হয়েছিল----

إِنّ هَاتَيْنِ صَامَتَا عَمّا أَحَلّ اللهُ لَهُمَا، وَأَفْطَرَتَا عَلَى مَا حَرّمَ اللهُ عَلَيْهِمَا.

অর্থ : এরা দু’জন তো আল্লাহ্ যা হালাল করেছেন তা থেকে বিরত থেকেছে। কিন্তু ঐ সব কাজ থেকে বিরত থাকেনি, যা আল্লাহ্ (সবসময়ের জন্য) হারাম করেছেন। [মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ২৩৬৫৩]


রোযাদারের মুখের দুর্গন্ধ আল্লাহর নিকট মেশকের চেয়েও অধিক প্রিয় :

রোযাদার ব্যক্তি দিনভর উপোস থাকে। অনাহারে থাকার দরুন তার মুখে একধরনের দুর্গন্ধ সৃষ্টি হয়। দুনিয়াবী বিবেচনায় তা দুর্গন্ধ মনে হলেও রাব্বুল 'আলামীনের নিকট তা মেশকের চাইতেও অধিক প্রিয়। নবীজী (ছাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াছাল্লাম) বলেন----

وَالّذِي نَفْسُ مُحَمّدٍ بِيَدِهِ، لَخُلُوفُ فَمِ الصّائِمِ أَطْيَبُ عِنْدَ اللهِ مِنْ رِيحِ المِسْكِ.

(অনুবাদ :) ঐ সত্তার কসম, যার কব্জায় মুহাম্মাদের প্রাণ, রোযাদারের মুখের দুর্গন্ধ আল্লাহ্র নিকট মেশকের সুগন্ধি অপেক্ষা অধিক প্রিয়।  [সহীহ বুখারী, হাদীস ১৯০৪]

তবে এক্ষেত্রে লক্ষণীয় হল, মুখ অপরিষ্কার হওয়ার দরুন যে দুর্গন্ধ ছড়ায় তা এখানে উদ্দেশ্য নয়; বরং মুখ পরিচ্ছন্ন রাখার ব্যাপারে ইসলাম গুরুত্বের সাথে তাকিদ করেছে। রোযা অবস্থায় না খেয়ে থাকার দরুন ক্ষুধার কারণে মুখে যে দুর্গন্ধ সৃষ্টি হয়, এখানে তা-ই উদ্দেশ্য।


ঘ) রোযাদারের জন্য বিশেষ আনন্দের মুহূর্ত :

রাসূলুল্লাহ্ (ছাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াছাল্লাম) বলেন---

لِلصّائِمِ فَرْحَتَانِ: فَرْحَةٌ عِنْدَ فِطْرِهِ، وَفَرْحَةٌ عِنْدَ لِقَاءِ رَبّهِ.

অর্থ : রোযাদারের জন্য দুটি বিশেষ আনন্দের মুহূর্ত রয়েছে। একটি হল, ইফতারের সময়। অপরটি হল, যখন সে তার রবের সাথে সাক্ষাৎ করবে (আর তিনি তাকে বিশাল পুরস্কার ও সম্মানে ভূষিত করবেন)।  [সহীহ মুসলিম, হাদীস ১১৫১]

রোযাদার দিনভর আল্লাহ্ তা'আলার হুকুমে উপবাস থাকার পর যখন আল্লাহর হুকুম মোতাবেক ইফতারি নিয়ে বসে তখন তাঁর মনে অন্যরকম আনন্দ এবং অপার্থিব প্রশান্তির এক ঢেউ খেলে যায়। আর কিয়ামতের ময়দানে যখন সে রবের নিকট থেকে এর প্রতিদান গ্রহণ করবে ঐ মুহূর্তটিও তার জন্য হবে অবারিত আনন্দের।


রোযাদারের দু'আ ফিরিয়ে দেওয়া হয় না :

রোযাদার ব্যক্তি আল্লাহ্ তা'আলার নিকট এতটাই মহব্বতের পাত্র যে, সে কিছু চাইলে আল্লাহ্ পাক তা ফিরিয়ে দেন না। নবীজী (ছাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াছাল্লাম) বলেন---

ثَلاَثَةٌ لاَ تُرَدّ دَعْوَتُهُمْ: الصّائِمُ حَتّى يُفْطِرَ، وَالإِمَامُ العَادِلُ، وَدَعْوَةُ الْمَظْلُومِ يَرْفَعُهَا اللهُ فَوْقَ الغَمَامِ وَيَفْتَحُ لَهَا أَبْوَابَ السّمَاءِ وَيَقُولُ الرّبّ: وَعِزّتِي لأَنْصُرَنّكِ وَلَوْ بَعْدَ حِينٍ.

(অনুবাদ :) তিন ব্যক্তির দুআ ফিরিয়ে দেওয়া হয় না। এক. রোযাদারের দু'আ ইফতার পর্যন্ত। দুই. ন্যায়পরায়ণ শাসকের দু'আ। তিন. মজলুমের দু'আ। আল্লাহ্ এ দু'আকে মেঘমালার উপরে নিয়ে যান। এর জন্য আসমানের দরজাসমূহ খুলে দেন। রব বলেন, আমার ইযযতের কসম, বিলম্বে হলেও আমি তোমাকে সাহায্য করব।  [জামে তিরমিযী, হাদীস ৩৫৯৮; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ১৭৫২; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ৯৭৪৩]


রোযাদারের জন্য রোযা সুপারিশ করবে : 

কিয়ামতের দিন রোযাদারের জন্য রোযা নিজে সুপারিশ করবে। হাদীসে এসেছে----

الصِّيَامُ وَالْقُرْآنُ يَشْفَعَانِ لِلْعَبْدِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ، يَقُولُ الصِّيَامُ: أَيْ رَبِّ، مَنَعْتُهُ الطّعَامَ وَالشّهَوَاتِ بِالنّهَارِ، فَشَفِّعْنِي فِيهِ، وَيَقُولُ الْقُرْآنُ: مَنَعْتُهُ النّوْمَ بِاللّيْلِ، فَشَفِّعْنِي فِيهِ، قَالَ: فَيُشَفّعَانِ .

(অনুবাদ :) কিয়ামতের দিন সিয়াম ও কুরআন বান্দার জন্য সুপারিশ করবে। রোযা বলবে, ওগো রব! দিবসে আমি তাকে পানাহার ও (বৈধ) জৈবিক চাহিদা পূরণ থেকে নিবৃত্ত রেখেছি। তার ব্যাপারে আপনি আমার সুপারিশ কবুল করুন। আর কুরআন বলবে, রাতে আমি তাকে নিদ্রা থেকে বিরত রেখেছি। তার ব্যাপারে আপনি আমার সুপারিশ কবুল করুন। অতঃপর তাদের সুপারিশ কবুল করা হবে।  [মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ৬৬২৬; মাজমাউয যাওয়াইদ, হাদীস ৫০৮১]

রোযাদারের জন্য জান্নাতে প্রবেশের বিশেষ ফটক থাকবে :

রোযাদার হলেন আল্লাহ্ তা'আলার বিশেষ মেহমান। জান্নাতে প্রবেশের জন্য তার সৌজন্যে বিশেষ ফটকের ব্যবস্থা থাকবে। নবীজী (সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন----

إِنّ فِي الجَنّةِ بَابًا يُقَالُ لَهُ الرّيّانُ، يَدْخُلُ مِنْهُ الصّائِمُونَ يَوْمَ القِيَامَةِ، لاَ يَدْخُلُ مِنْهُ أَحَدٌ غَيْرُهُمْ، يُقَالُ: أَيْنَ الصّائِمُونَ؟ فَيَقُومُونَ لاَ يَدْخُلُ مِنْهُ أَحَدٌ غَيْرُهُمْ، فَإِذَا دَخَلُوا أُغْلِقَ فَلَمْ يَدْخُلْ مِنْهُ أَحَدٌ.

(অনুবাদ :) জান্নাতে একটি দরজা রয়েছে। নাম রাইয়ান। কিয়ামতের দিন তা দিয়ে রোযাদাররা প্রবেশ করবে। তারা ব্যতীত অন্য কেউ সেই দরজা দিয়ে প্রবেশ করতে পারবে না। ঘোষণা করা হবে, রোযাদাররা কোথায়? তখন তারা আসবে। তারা ছাড়া তা দিয়ে আর কেউ প্রবেশ করবে না। রোযাদাররা প্রবেশ করার পর দরজা বন্ধ করে দেওয়া হবে। এরপর আর কেউ তা দিয়ে প্রবেশ করতে পারবে না।  [সহীহ বুখারী, হাদীস ১৮৯৬; সহীহ মুসলিম, হাদীস ১১৫২]

 

সাহরী : গুরুত্ব ও ফযীলত :

রোযার নিয়তে সুবহে সাদিকের পূর্বে যে খাবার গ্রহণ করা হয় তা হল সাহরী। সাহরী খাওয়া সুন্নত। সাহরীতে পেট ভরে খাওয়া আবশ্যক নয়; এক দুই ঢোক পানি পান করেও এ সুন্নত আদায় করা যায়।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Be alert before spamming comments.

নবীনতর পূর্বতন

Sponsored

Responsive Ad