ইসলাম কী দিয়েছে নারীকে?
►কন্যা সন্তানের জন্মকে বলা হল ‘সুসংবাদ’
وَإِذَا بُشِّرَ أَحَدُهُمْ بِالْأُنْثَى ظَلَّ وَجْهُهُ مُسْوَدًّا وَهُوَ كَظِيمٌ l يَتَوَارَى مِنَ الْقَوْمِ مِنْ سُوءِ مَا بُشِّرَ بِهِ أَيُمْسِكُهُ عَلَى هُونٍ أَمْ يَدُسُّهُ فِي التُّرَابِ أَلَا سَاءَ مَا يَحْكُمُونَ
তাদের কাউকে যখন কন্যা সন্তানের ‘সুসংবাদ’ দেয়া হয় তখন তার চেহারা মলিন হয়ে যায় এবং সে অসহনীয় মনস্তাপে ক্লিষ্ট হয়। সে এ সুসংবাদকে খারাপ মনে করে নিজ সম্প্রদায় থেকে লুকিয়ে বেড়ায় (এবং চিন্তা করে ) হীনতা স্বীকার করে তাকে নিজের কাছে রেখে দেবে,নাকি মাটিতে পুঁতে ফেলবে। কত নিকৃষ্ট ছিল তাদের সিদ্ধান্ত। (সূরা নাহ্ল,আয়াত : ৫৮-৫৯)
আধুনিক জাহেলী যুগে আজো কিন্তু নারীর জন্ম ‘সুসংবাদ’ নয়
► আদর কোন্ সন্তানকে বেশি
হাদীসের প্রসিদ্ধ ও প্রাচীন গ্রন্থ ‘মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক’-এ ইমাম আবদুর রাযযাক ইবনে হাম্মাম (মৃত্যু : ১২৬ হি.-২১১ হি.) বর্ণনা করেন, জনৈক আনসারী সাহাবীকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ডাকলেন। ইতিমধ্যে ঐ সাহাবীর এক পুত্র তার কাছে এল। তিনি তাকে চুমু খেয়ে বুকে জড়িয়ে নিলেন এবং কোলে বসালেন। কিছুক্ষণ পর তার এক কন্যাও সেখানে উপস্থিত হল। তিনি তার হাত ধরে নিজের কাছে বসালেন। এটি লক্ষ করে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করলেন-
ولو عدلت كان خيرا لك، قاربوا بين أبنائكم ولو في القبل. وفي رواية الطحاوي : فهلا عدلت بينهما؟
অর্থাৎ উভয় সন্তানের প্রতি তোমার আচরণ অভিন্ন হওয়া উচিত ছিল। তোমরা নিজেদের সন্তানদের মাঝে সমতা রক্ষা করো। এমনকি চুমু খাওয়ার ক্ষেত্রেও।-মুসান্নাফ আবদুর রাযযাক ৯/১০০
►কোন্ সন্তানকে ভাল উপহারটা দিবেন
বশীর ইবনে সাদ রা. একবার নিজপুত্র নুমান ইবনে বশীরকে কিছু জিনিস হাদিয়া করলেন এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে স্বাক্ষী বানানোর জন্য নুমানকে তাঁর নিকট নিয়ে এলেন। নবীসাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি কি তোমার সকল সন্তানকে এরুপ উপহার দিয়েছ? তিনি বললেন, জ্বী না। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করলেন-
فاتقوا الله واعدلوا في أولادكم. وفي رواية : قاربوا بين أولادكم.
অর্থাৎ আল্লাহকে ভয় কর এবং সন্তানদের মাঝে সমতা রক্ষা কর। (আর এতটুকু চেষ্টা অবশ্যই কর যে, উপহার-সদাচার ইত্যাদির ক্ষেত্রে প্রত্যেকের অংশ যেন কাছাকাছি হয়।)-সহীহ মুসলিম, হাদীস : ৪০৫৯, ৪০৬৪; মুসান্নাফ আবদুর রাযযাক ৯/৯৮
►পিতা-মাতার ভিতর কাকে অগ্রাধিকার বেশি
“রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে একবার জিজ্ঞাসা করা হলো যে ইয়া রাসূলাল্লাহ! পিতা-মাতার মধ্যে আমার কাছে সবচেয়ে বেশি সম্মান ও মর্যাদার হকদার কে? প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তখন বললেন, তোমার মা। সাহাবী জিজ্ঞেস করলেন, তারপর কে? প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তখন বললেন, তোমার মা। সাহাবী জিজ্ঞেস করলেন, তারপর কে? প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তখন বললেন, তোমার মা। এরপর সাহাবী চতুর্থ বার যখন জিজ্ঞেস করলেন যে, তারপর কে? তখন প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তখন বললেন, তোমার বাবা।” (বুখারী ও মুসলিম)
►সন্তানের জান্নাত কার পায়ের নিচে
হযরত মুয়াবিয়া বিনতে জাহিমা নবীজীর সা. এর কাছে এসে বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি যুদ্ধে যেতে চাচ্ছি। আপনার কাছে পরামর্শের জন্য এসেছি। তিনি বললেন, তোমার মা আছে কি? সে বলল, হ্যাঁ। তিনি বললেন, তাহলে তাঁকে সঙ্গ দাও। কেননা জান্নাত তাঁর দুই পায়ের নিচে।” (সুনানে নাসাঈ )
►নারীর প্রতি মিথ্যা অপবাদ দিলে কী শাস্তি
“আর যারা সচ্চরিত্র নারীর প্রতি অপবাদ আরোপ করে, তারপর তারা চারজন সাক্ষী নিয়ে আসে না, তবে তাদেরকে আশিটি বেত্রাঘাত কর এবং তোমরা কখনই তাদের সাক্ষ্য গ্রহণ করো না। আর এরাই হলো ফাসিক।” (সুরা আন-নূর: আয়াত ৪)
►আমলের প্রতিদান কাকে বেশি দেয়া হবে
“যে মুমিন অবস্থায় নেক আমল করবে, পুরুষ হোক বা নারী, আমি তাকে পবিত্র জীবন দান করব এবং তারা যা করত তার তুলনায় অবশ্যই আমি তাদেরকে উত্তম প্রতিদান দেব।” (সুরা আন-নাহল: আয়াত ৯৭)
“আর পুরুষ কিংবা নারীর মধ্য থেকে যে নেককাজ করবে এমতাবস্থায় যে, সে মুমিন, তাহলে তারা জান্নাতে প্রবেশ করবে এবং তাদের প্রতি খেজুরবীচির আবরণ পরিমাণ যুল্ম ও করা হবে না।” (সুরা নিসা: আয়াত ১২৪)
►বিবাহের সময় মোহর কে পায়
“আর তোমরা নারীদেরকে সন্তুষ্টচিত্তে তাদের মোহর দিয়ে দাও।” (সূরা নিসা: আয়াত ৪)
►সম্পদ বণ্টনের ব্যাপারে ইসলাম নারীকে কী দিয়েছে
পিতা-মাতা এবং নিকটতর আত্মীয়দের পরিত্যাক্ত সম্পত্তিতে পুরুষের অংশ আছে এবং পিতামাতা ও নিকটতর আত্মীয়দের পরিত্যাক্ত সম্পত্তিতে নারীরও অংশ আছে। তা অল্পই হোক বা বেশি, এক নির্ধারিত অংশ। -সূরা নিসা : ৭
মেয়েকে তার প্রাপ্য হিস্যা থেকে কম দেওয়া বা একেবারেই না দেওয়া শরীয়তের দৃষ্টিতে জুলুম ও নাজায়েয। হাদীস শরীফে আছে, যে ব্যক্তি তার ওয়ারিশকে মীরাছ থেকে বঞ্চিত করে আল্লাহ তাআলা তাকে জান্নাতের অংশ থেকে বঞ্চিত করবেন। -মুসান্নাফ ইবনে আবী শাইবা ১৬/২১৫
►খাওয়া পড়ার ব্যবস্থা কার দায়িত্বে
সন্তানের পিতার উপর দায়িত্ব নিয়ম অনুযায়ী মাতার খাওয়া-পরার ব্যবস্থা করা।
-সূরা বাকারা : ২৩৩
►নারীকে তালাক দিলেও খরচের ব্যাপারে কী বলে ইসলাম
আর তালাকপ্রাপ্তা নারীদের জন্য প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী খরচ দেয়া পরহেযগারদের উপর কর্তব্য। (Al-Baqara: 241)
►পাত্র নির্বাচনের ক্ষেত্রে ইসলাম নারীকে কী অধিকার দিয়েছে
একদা এক মহিলা সাহাবি রাসুল (সাঃ) এর কাছে এসে অভিযোগ করলেন আমার বাবা যার সাথে আমার বিয়ে দিয়েছেন তাকে আমার পছন্দ নয়। তখন রাসুল (সাঃ) সঙ্গে সঙ্গে সেই বিয়ে বাতিল করে দিলেন। (সহিহ বুখারি ৭ম খণ্ড, নিকাহ অধ্যায়)
►ইসলামে কি নারীদের যৌন চাহিদার কোন স্বীকৃতি আছে
আনাস বিন মালিক (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেছের নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, যখন পুরুষ তার স্ত্রীর সাথে সহবাস করে তখন সে যেন পরিপূর্ণভাবে (সহবাস) করে। আর তার যখন চাহিদা পূরণ হয়ে যায় (শুক্রস্খলন হয়) অথচ স্ত্রীর চাহিদা অপূর্ণ থাকে, তখন সে যেন তাড়াহুড়া না করে। [মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক, হাদিস নং-১০৪৬৮]
►স্বামীকে স্ত্রীর সাথে কী রকম ব্যবহার করতে বলে ইসলাম
‘তোমরা নিজ পত্নীদের প্রতি সদয় ব্যবহার করবে। নিশ্চয়ই আল্লাহকে সাক্ষী রেখে তোমরা তাদের গ্রহণ করেছ এবং তাঁরই আদেশমতো তাদের তোমাদের জন্য বৈধ করে নিয়েছ। মুমিন স্বামী ইমানদার স্ত্রীর প্রতি বিদ্বেষ ভাব পোষণকারী হবে না। কারণ, স্ত্রীর কোনো ব্যবহারে মনে কষ্ট এলেও পুনরায় তার দ্বারাই এমন ব্যবহার পাবে, যাতে সন্তুষ্টি লাভ হবে।’ (মুসলিম)
►শিক্ষা-দীক্ষার ব্যাপারে ইসলাম নারীকে কী অধিকার দিয়েছে
‘‘যারা জ্ঞানী ও বিদ্যান তারা বলেন, আমরা এর (কুরআন) প্রতি ঈমান এনেছি এবং কেবল বিবেক সম্পন্ন লোকেরাই (কোনো জিনিস থেকে) শিক্ষা গ্রহণ করতে পারবে।’’
সূরা আলে ইমরান : ৭
(এখানে নারী ও পুরুষ কোন পার্থক্য করা হয় নাই)
“যে ব্যক্তি তিনটি কন্যা সন্তান বা তিনটি বোনকে লালন-পালন করবে এবং তাদেরকে ভদ্রতা, শিষ্টাচার, উত্তম চালচলন ও আচার ব্যবহার শিক্ষা দিয়ে সাবলম্বী হতে সাহায্য করবে, আল্লাহ তার জন্য জান্নাত ওয়াজিব করে দেবেন। এক ব্যক্তি জিজ্ঞাসা করলো, হে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, কেউ যদি দুজনের জন্য এরূপ করে? তিনি বললেন, দু’জনের জন্য এরূপ করলেও হবে।”
শারহুস সুন্নাহ, হাদীস নং ৩৪৫৭
আনসারী মহিলাদের সম্পর্কে আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা বলেনঃ
‘‘আনসারী মহিলারা কতই না ভাল! দীনের বিধি-বিধান সম্পর্কে জ্ঞান লাভের ক্ষেত্রে লজ্জা-শরম তাদের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে নি।’’
মুসলিম, সহীহ্ মুসলিম, ১ম খণ্ড, প্রাগুক্ত, পৃ. ২৬১
পুরুষদের শিক্ষার পাশাপাশি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নারী শিক্ষারও পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। তিনি সপ্তাহের একটি বিশেষ দিনে নারীদের নিকট বক্তৃতা করতেন এবং তাদের প্রশ্নের উত্তর দিতেন। সম্ভ্রান্ত মহিলাদের তো কথাই নেই। এমনকি দাসীদেরকেও শিক্ষা দান করার জন্য নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আদেশ করেছেন।’’
আবু আব্দুল্লাহ্ মুহাম্মদ ইবনে ইসমাইল, কিতাবুল ইলম, পূর্বোক্ত, পৃ. ২০
‘‘মহিলারা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বললো, আপনার কাছে পুরুষরা এত ভিড় লাগিয়ে থাকে যে, অনেক সময় আমাদের পক্ষে আপনার কথা শুনা সম্ভবই হয় না। অতএব আমাদের জন্য আপনি আলাদা একটি দিন ধার্য করে দিন। একথা শুনে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের জন্য একটি দিন নির্দিষ্ট করে দিলেন। সেই দিন তিনি তাদের কাছে গিয়ে উপদেশ দিতেন এবং সৎকাজের নির্দেশ দান করতেন।’’
বুখারী, সহীহুল বুখারী, প্রাগুক্ত, পৃ. ২০
‘‘তোমরা তোমাদের স্ত্রী-পুত্রের কাছে ফিরে যাও এবং তাদের কাছেই অবস্থান কর। তাদেরকে দীন সম্পর্কে শিক্ষা দাও এবং তা মেনে চলার নির্দেশ দাও।’’
বুখারী, সহীহুল বুখারী, ১ম খণ্ড, কিতাবুল আযান, প্রাগুক্ত, পৃ. ৮৮
ইসলামের শিক্ষা সম্পর্কে সে যুগের মহিলারা কত গভীর ও সূক্ষ্ম দৃষ্টি নিয়ে অধ্যয়ন করতেন আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা-এর নিম্নের উক্তি হতেই তা বোঝা যায়ঃ
‘‘নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর যুগে কুরআন মাজীদের কোনো আয়াত নাযিল হলে, আমরা তার শব্দগুলো হুবহু মুখস্থ না করলেও তার হালাল-হারাম এবং আদেশ-নিষেধগুলো স্মৃতিপটে গেঁথে নিতাম।’’
ইবন আবদি রাব্বিহি, আল্-ইকদুল ফরীদ, ১ম খণ্ড, কায়রোঃ মাতবাআতু লাজনাতিত্ তা’লীক, ১৯৬৫, পৃ. ২৭৬
আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা-এর বিভিন্ন বিষয়ে ব্যাপক জ্ঞান সম্পর্কে তাঁর ছাত্র উরওয়া ইবন্ যুবায়র রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেছেন,
‘‘আমি কুরআন, ইসলামের ফরযসমূহ, হালাল ও হারাম, কাব্য ও সাহিত্য, আরবদের ইতিহাস ও নসবনামা বিষয়ক জ্ঞানের ক্ষেত্রে আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা-এর চেয়ে অধিক জ্ঞানী লোক আর দেখি নি। ।
হাফিজ যাহাবী, তাযকিরাতুল হুফফাজ, ১ম খণ্ড, বৈরুতঃ দারু ইহ্ইয়ায়িত্ তুরাসিল আরাবী, তা. বি., পৃ.২৭
মূসা ইবন্ তালহা বলেনঃ
‘‘আমি আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা-এর চেয়ে অধিক বাগ্মী ও শুদ্ধভাষী আর কাউকে দেখি নি।’’
ইবনে হাজার আল্-আসকালানী, আল্ ইসাবা ফী তামীযিস্ সাহাবা, ৪র্থ খণ্ড, প্রাগুক্ত, পৃ. ৩৬০
ইবনে আবী মূলায়কা আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা-কে বললেন,আপনি চিকিৎসা বিদ্যা কিভাবে শিখেছেন?
আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা বললেনঃ
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অসুস্থ হয়ে পড়লে বাইরে থেকে আগত প্রতিনিধিদল তাঁর চিকিৎসা করতো। আমি সেগুলো মনে রাখতাম।
হাকেম, মুসতাদরাক, ৪র্থ খণ্ড, প্রাগুক্ত, পৃ. ১১